সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজের মাধ্যমে উগ্রবাদ ছড়ানোর পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে পরিচিতি পান মাহমুদুল হাসান গুনবী। ধর্মীয় প্রচারণার আড়ালে কৌশলে কথিত জিহাদ ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের দলে বেড়ানোর উদ্দেশ্য লক্ষণীয়। ইসলামি এই বক্তা ওয়াজের নামে কথিত জিহাদের ডাক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে আসছেন।
ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে কোমলমতি কিশোর-তরুণদের ব্রেনওয়াশের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ইউটিউবে ওয়াজের নামে উগ্রবাদ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতেন। তার ভুল ব্যাখ্যায় মোটিভেটেড হয়ে অনেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। তারই ওয়াজ নসিহতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্প্রতি সাকিব নামের এক তরুণ তলোয়ার নিয়ে সংসদ ভবন আক্রমণ করতে গেলে র্যাবের হাতে আটক হন।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, আল-কায়েদা মতাদর্শী একটি জঙ্গিগোষ্ঠী দাওয়াতুল ইসলাম নামের একটি সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতি কাজ চালাচ্ছে। দাওয়াতুল ইসলাম নামের সংগঠনের আড়ালে পার্বত্য এলাকায় এই উগ্রবাদী কার্যক্রমের নেতৃত্বে আছেন মাহমুদুল হাসান গুনবী। তিনি বান্দরবানের লামা ও খাগড়াছড়িতে দুটি জঙ্গি আস্তানাও গড়ে তুলেছেন। সেখানে এই গোষ্ঠী ২০ থেকে ২৫ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
জঙ্গি কার্যক্রমে গোয়েন্দা নজরদারিতে যুক্ত একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, উগ্রবাদী ওয়াজের জন্য পরিচিত মাহমুদুল হাসান গুনবী বর্তমানে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা। তবে তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, দাওয়াতুল ইসলাম নামের একটি সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই সংগঠনের কার্যক্রমের নামে পার্বত্য অঞ্চলে এবং উত্তরবঙ্গে চরাঞ্চলের কিছু এলাকায় আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম ও উগ্র মতাদর্শ প্রচার করে আসছেন। আনসার আল ইসলাম নিজেদের আল–কায়েদার ভারত উপমহাদেশের (একিউআইএস) শাখা দাবি করে থাকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, মাহমুদুল হাসান গুনবী ‘মানহাজি’ নামক একটি উগ্রবাদী গ্রুপের মুখ্য ব্যক্তি হিসেবেও কাজ করছেন। তিনিসহ তিনজন এই গ্রুপের অন্যতম দায়িত্বশীল। বাকি দুজন হলেন মাওলানা হারুন ইজহার ও আলী হাসান ওসামা। এই দুজন গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন। এই মানহাজি গ্রুপও হেফাজতে ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গোপনে তৎপর রয়েছে। মানহাজি গ্রুপও আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে এবং হেফাজতে ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সংগঠিত হয়েছে বলে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পেরেছে।
আল-কায়েদা মতাদর্শী একটি জঙ্গিগোষ্ঠী দাওয়াতুল ইসলাম নামের একটি সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতি কাজ চালাচ্ছে। দাওয়াতুল ইসলাম নামের সংগঠনের আড়ালে পার্বত্য এলাকায় এই উগ্রবাদী কার্যক্রমের নেতৃত্বে আছেন মাহমুদুল হাসান গুনবী। তিনি বান্দরবানের লামা ও খাগড়াছড়িতে দুটি জঙ্গি আস্তানাও গড়ে তুলেছেন। সেখানে এই গোষ্ঠী ২০ থেকে ২৫ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
মাহমুদুল হাসান গুনবীও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে এই সংগঠনকেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হেফাজতের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে গুনবীর ছবি দেখা গেছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাহমুদুল হাসান গুনবী হেফাজতের কোনো কমিটি বা পদে নেই। তার বিভিন্ন বয়ানে এনজিওবিরোধী বক্তব্য থাকে, বিশেষ করে পার্বত্য এলাকায়। সম্প্রতি বান্দরবানে ওমর ফারুক নামে একজন নও–মুসলিম খুন হয়েছেন। সেই ওমর ফারুকও মাহমুদুল হাসান গুনবীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে শুনেছি।’
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, দাওয়াতুল ইসলামের বর্তমান আমির মাহমুদুল হাসান গুনবী। সংগঠনটির এর আগে আমির ছিলেন মাওলানা নাজিমুদ্দিন। তিনি জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। দাওয়াতুল ইসলামের সদস্য সাইফুল ইসলাম, আবদুল হামিদ, আনিছুর রহমান ও হাসান এর আগে জঙ্গি-সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
গুনবীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাওলানা আলী হাসান ওরফে ওসামাকে গত মে মাসে রাজবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জাতীয় সংসদ ভবনে হামলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আলী হাসান ওসামার সঙ্গে আনসার আল ইসলামের আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মাহমুদুল হাসান গুনবীর নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য সামনে আসে। সংসদ ভবনে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় গুনবীকে পলাতক আসামি হিসেবে দেখানো হয়। গত মে মাসে ওই মামলার পর গুনবী আত্মগোপনে চলে যান। খাগড়াছড়ির গহিন পাহাড়ে আত্মগোপনে আছেন, এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গুনবীকে গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েক দফা পাহাড়ে অভিযানও চালায়।
দাওয়াতুল ইসলাম ও মাহমুদুল হাসান গুনবীর বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে দাওয়াতুল ইসলামের নাম বলেছে। সংগঠনটি উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘গুনবী সম্পর্কেও আমাদের কাছে কিছু গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তিনি উগ্রবাদী বক্তব্য ও শিক্ষা দেওয়ার নামে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলামের কিছু জঙ্গির কাছ থেকেও তথ্য পেয়েছি। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী ও সংস্থার মতো আমরাও তাঁকে খুঁজছি।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, আলি হাসান উসামার মতো ওয়াজের নামে যারা প্রতিনিয়ত উগ্রবাদ প্রচার করে আসছেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় অন্তত ১০ থেকে ১২ জন ইসলামি বক্তার নাম রয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে ১৫ জন ইসলামি বক্তার একটি তালিকা তৈরি করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বক্তারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে সুপারিশও করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই তালিকায় যেসব বক্তাদের নাম ছিল সাম্প্রতিক সময়ে এদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে এখনও বেশ কয়েকজন কথিত ইসলামি বক্তা নিয়মিত ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদের ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অন্যতম দুই জন মাহমুদুল হাসান গুনবী ও মুফতি আমির হামজাকে আইনের আওতায় আনার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানের কারণে এই দুজনও আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে খুব শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, যারা কট্টর বয়ানের মাধ্যমে উগ্রবাদ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে না পারলে দেশে আবারও জঙ্গি হামলাসহ নানা সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাবে। এসব বক্তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যার বদলে তারা মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে এখনই জিহাদের সময় বলে তরুণদের ভুল পথে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৯
আপনার মতামত জানানঃ