সেক্যুলারিজমকে আলাদা ক’রে জায়গা দেয়া হয়েছিল ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল টাইম থেকেই এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মকে আইডিওলজি বানিয়ে করা হয়েছিল শাসনের হাতিয়ার। বাঙালি দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মের নামে শোষিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু এই জায়গাটাই শুধরাতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর আওয়ামী লীগই যে একটা সময়ে এসে বাংলাদেশকে পলিটিক্যালি ইসলামিক দেশ হিসাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবে, তা হয়তো তিনি কখনও ভাবেননি।
স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের এমপি এবং এমএনএদের শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘এ দেশে ইসলাম, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবই থাকবে এবং বাংলাদেশও থাকবে। হিন্দু বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে গত এক দশকে যে অত্যাচার হয়েছে তার অবসান হবে।’ (সূত্র: শেখ মুজিব; বাংলাদেশের আরেক নাম ড : আতিউর রহমান, পৃষ্ঠা ২১৯)। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতায় জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’
তবে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘৭৫-এর পর এই অবস্থান থেকে সরে যেতে থাকে বাংলাদেশ। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজমকে উপড়ে ফেলেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আবার ফুঁসেফেঁপে ওঠে। এরপরই ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট দল জামায়াতে ইসলামী আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। এ সময় আওয়ামী লীগ মুসলমানবিদ্বেষী, হিন্দুদের দল, ভারতের দালাল এমন কিছু ট্যাগ পায়। যা আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতারাও নিজেদের ‘মুসলমান’ প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এই প্রমাণ করতে গিয়েই আওয়ামী লীগ নিজেই নিজদের আইডিওলিজির জায়গা থেকে সরে আসে। গলা টিপে ধরে সেক্যুলারিজমের।
১৯৭৮ সালে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম বাদ দেয়া হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চরিত্র পরিবর্তন করে দেন তখনকার স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ৷ তার শাসনামলে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সংবিধানের ঐ অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়, ‘‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে৷” সার্কাস্টিক বিষয় হইলো, এতসব করেও এরশাদ ধর্মকে বাগে আনতে পারেন নাই। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও ইসলামপন্থী দলগুলো অংশগ্রহণ করে। ১৯৯১–পরবর্তী গণতান্ত্রিক পর্বে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোট তাদের ক্ষমতা রক্ষা ও দখলের লড়াইয়ে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করে।
১৯৯৬–এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সংসদের ভেতরে-বাইরে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। বিএনপির বিরুদ্ধে তারা একযোগে আন্দোলন করে। পরে ১৯৯৯ সালে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করে ২০০১–এর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় এবং জয়লাভ করে। এভাবেই বাংলাদেশের পলিটিক্সে প্রধান এই দুই দলের ইসলামি দলগুলোর উপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। আর ফ্যানাটিক ইসলামিস্টদের এই দলগুলো দেশের মেরুদণ্ড বাঁকাতে উঠে পড়ে লেগে যায়। জানুয়ারি ২০০৭-এ জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের সেক্যুলার হিসেবে দাবি করলেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামের একটি কট্টর ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের উপস্থিতি সেক্যুলার বাংলাদেশের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। বাংলাদেশে মোট ৬৬টি ইসলামপন্থী দলের মধ্যে ৬১টি জোটভুক্ত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে, আর পাঁচটি যুক্ত হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে।
এরপর বাকিটা আর ইতিহাস না। আমাদের জেনারেশনের চোখের সামনে পলিটিক্যালি রিলিজিয়াস একটা কান্ট্রি সফলভাবে গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। গত এক যুগ টানা ক্ষমতায় আছে এই দলটি। অটোক্রেসির উত্থান ঘটছে তাদের হাত ধরেই। ফ্যানাটিক মুসলিমদের সাথে তাদের সম্পর্কের মাখামাখি দেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সুন্দর স্বাভাবিকভাবে নিরাপদে থাকাটাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। আর ঘটেছেও তাই।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ হয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বৌদ্ধপল্লীর বসতবাড়ি। ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ার হিন্দুপল্লী বনগ্রাম আক্রান্ত হয়। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আক্রমণ করা হয় কুমিল্লার হোমনা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বাঘসীতারামপুরে। কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, কখনো রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঠাকুরপাড়ায়, কখনো ভোলার বোরহানউদ্দিনে, কখনো কুমিল্লার কোরবানপুর গ্রামে চলেছে নৃশংসতা। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে তাণ্ডব চালানো হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু প্রতিটি ঘটনায় সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। বরং কোথাও কোথাও এসব ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ইন্ধনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি জাতির পিতার ১০২তম জন্মদিনের দিন সুনামগঞ্জের শাল্লায় নারকীয় তাণ্ডব ঘটানো হয়। হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রামে চালানো হয় সন্ত্রাসী হামলা। লুটপাট করা হয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ওই দিন অন্তত ৮৮ বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার অজুহাতে এ তাণ্ডব চালানো হয়। এইখানেও ধর্ম মানুষকে ডমিনেট করেছে।
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম নামের মৌলবাদী গোষ্ঠী ঢাকায় তাণ্ডব চালালে আওয়ামী লীগ সরকার বিচক্ষণতার সাথেই তা সামাল দেয়। এরপরেই সেক্যুলারিজমের ভোল পাল্টে ইসলামিস্ট হয়ে ওঠে দলটি। হেফাজতের তাণ্ডবকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলে যায় ফাইলের পর্বতের নিচে। হেফাজতের সঙ্গে প্রকাশ্যে গোপনে এক সখ্য তৈরি হয় আওয়ামী লীগের। হেফাজতের দাবিতে পাল্টে যায় পাঠ্যপুস্তক। হেফাজতের আমির আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজত আরও উগ্রবাদী হয়ে ওঠে। কথায় কথায় সরকারকে আলটিমেটাম দেয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধিতা করে। এই পর্যায়ে হেফাজতে ইসলাম আওয়ামী লীগকে পলিটিক্যালি আউটরান করার ইঙ্গিত দেখালে, সরকার সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করেই কঠোর অবস্থান নেয়। গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে হেফাজতের পলিটিক্যাল এথিক্স। তবে এর আগে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সহাবস্থানের নীতি তাতে চোখ এড়িয়ে যায় না।
যদিও আওয়ামী লীগ ইসলামের বাইরে আরও একটি ধর্ম তৈরি করছে আমাদের মধ্যে। এইটা আরও বেশি সেনসিটিভ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানীংকালে। সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাধারণ মানুষের অবদান টেবিলের কোণায় রেখে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে একটা গ্রান্ড ন্যারেটিভ দাঁড় করানো। যার উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ মানুষের মাঝে একটি অলঙ্ঘনীয় ধর্ম বানিয়ে ফেলা। আর এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট দলকে এবং কিছুসংখ্যক মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের হেফাজতকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা সমালোচনার উর্ধ্বে। আইনের লম্বা হাত তাদের ঘাড় অব্দি পৌঁছায় না। সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করাটা স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশের পলিটিক্যালি চর্চিত নয়া ধর্ম। এই দুই ধর্মের মাঝে মানুষ স্যান্ডুইচ হয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকাটাকে গণতন্ত্র ভেবে মনে মনে আনন্দ নিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৩১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ