ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি তিন কোটি ডোজ পেতে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা ও সরকার। টিকার প্রথম চালান আসার পর গেল ফেব্রুয়ারিতে গণ টিকাদান শুরু করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী আগামী জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা সরবরাহের কথা থাকলেও মাত্র ৭০ লাখ ডোজ সরবরাহ করেছে সেরাম। এরপর নিজেদের চাহিদা মেটাতে টিকা রপ্তানিও মার্চ থেকে বন্ধ রেখেছে সেরাম। আগামী অক্টোবরের আগে টিকা রপ্তানি সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সেরাম সিইও আদর পুনেওয়ালা।
ফলে বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশ রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এবং চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
চীন ও রাশিয়ার টিকা আপাতত প্রতিটি এক কোটি করে মোট দুই কোটি ডোজ কেনার জন্য সম্মতি দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। তবে টিকা দুটির দাম নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে গুঞ্জন রয়েছে। ভারতের কোভিশিল্ডের চেয়েও বহুগুণ বেশি দামে চীন ও রাশিয়ার টিকা কিনতে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে স্পুটনিক-ভি টিকা কিনতে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হলেও এখনো দুদেশের মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। তবে একটি প্রস্তাবিত চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে রাশিয়া। সেখানে প্রতি ডোজ টিকার দাম ৯ দশমিক ৯৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে প্রতীয়মান হয়।
এদিকে চীনের টিকার দাম নিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে সেনেগাল সিনোফার্মের দুই লাখ ডোজ টিকার জন্য ৩৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের কিছু বেশি পরিশোধ করেছে, সেক্ষেত্রে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়েছে প্রায় ১৯ ডলার।
তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, গত মার্চে হাঙ্গেরি সিনোফার্মের প্রতিডোজ টিকার জন্য ৩৬ ডলার দিতে রাজি হয়েছে, যা একে বিশ্বের সবচেয়ে দামি টিকার অবস্থানে নিয়ে গেছে।
চীনে যারা এই টিকা নিয়েছেন তাদের উদ্ধৃত করে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই ডোজের জন্য তাদের ৬০ থেকে ১৫০ ডলারের মতো দিতে হয়েছে।
সিনোফার্ম জানিয়েছে, দুই ডোজের এই টিকার দাম ১৫০ ডলারের নিচেই থাকা উচিত।
তবে টিকা দুটির দাম এখনো নির্ধারণ হয়নি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি দর-কষাকষির মাধ্যমে টিকার মূল্য নির্ধারণ করবে বলে জানা গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সিনোফার্মের টিকার প্রতি ডোজের দাম ১৯ থেকে ৩৮ ডলার পর্যন্ত এবং রাশিয়ার টিকার মূল্য প্রতি ডোজের দাম ১২ থেকে ২৪ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
অন্যদিকে সেরামের প্রস্তুতকৃত টিকার প্রতি ডোজের জন্য ৫ ডলার করে (পরিবহন খরচসহ) পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সে হিসাবে চীন ও রাশিয়ার টিকা কিনতে সরকারকে চড়ামূল্য গুনতে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থ বিভাগ থেকে মতামত এসেছে। টিকার দাম নির্ধারণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রয়েছে। এ কমিটিই টিকার মূল্য নির্ধারণ করবে।
এদিকে ‘সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে’ চীন থেকে সিনোফার্মের উৎপাদিত করোনাভাইরাসের টিকা কেনার প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন করেছে সরকার।
আজ বুধবার অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয় বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তার জানান।
সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ইতোমধ্যে সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। চীনের প্রথম টিকা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও সবুজ সংকেত চেয়েছে এই টিকা।
শাহিদা আক্তার জানান, চীন থেকে কত দামে কী পরিমাণ ভ্যাকসিন কেনা হবে তা বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়নি। কতদিনের মধ্যে এই কেনাকাটা সম্পন্ন হবে তাও আলোচনা হয়নি।
এদিকে দেশে সিনোফার্ম ও স্পুটনিক-ভি টিকা উৎপাদন বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের টিকা উৎপাদন প্রস্তুতি অনেকটা এগিয়ে থাকলেও চীন-রাশিয়ার সঙ্গে শর্তের আলোচনা চলছে। শর্তের পাশাপাশি টিকার দাম নিয়েও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আলোচনায় সন্তোষজনক অবস্থার সৃষ্টি হলে চুক্তি চূড়ান্ত করা হবে।
ভারত থেকে ধোকা খেয়ে চীন ও রাশিয়ার টিকা কেনায় সতর্ক অবস্থানে সরকার
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত করোনাভাইরাসের টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ফের বাড়তে থাকায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানি আপাতত স্থগিত রাখার এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত করোনাভাইরাসের দেড় কোটি ডোজ টিকার জন্য অগ্রিম টাকা দেওয়া হলেও টিকা এসেছে ৭০ লাখ ডোজ। এখনো ৮০ লাখ ডোজ টিকা সেরাম ইনস্টিটিউট দেয়নি।
চুক্তি ছিল টিকা নিতে অগ্রিম টাকা দিতে হবে। সরকার সেটা করেছে। তবে ভারত চুক্তিমত এখনো টিকা সরবরাহ করতে পারেনি।
তাই ভারত থেকে ধোকা খাওয়ার পর সরকার এবার নড়েচড়ে বসেছে। চীন ও রাশিয়ার টিকা আপাতত প্রতিটি এক কোটি করে মোট দুই কোটি ডোজ কেনার সম্মতি দিলেও পুরো দাম আগেই পরিশোধ করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি চীনের সিনোফার্ম টিকা ক্রয়ের চুক্তির বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ বলেছে, প্রস্তাবিত শিডিউল অনুযায়ী তিন কিস্তিতে আপাতত এক কোটি ডোজ টিকা কেনা যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আলোচনার মাধ্যমে বাড়ানো যেতে পারে।
আরেক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অর্থ বিভাগের কাছে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা ক্রয় নিয়েও মতামত চেয়েছিল। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের বক্তব্য হলো প্রস্তাবিত চুক্তিটি সরকারের সঙ্গে সরকার (জিটুজি) নয়। এটি জিটুজি অথবা বিজনেস টু গভর্নমেন্ট (ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সরকার) পদ্ধতিতে করাই সমীচীন হবে। এসব টিকার চালান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরবরাহ নেয়াটা সমীচীন হবে। এক্ষেত্রে টিকার মূল্য, পরিবহন ব্যয়, বীমা খরচ ও স্থানীয় শুল্ক-কর ইত্যাদি সরকার বহন করবে। স্পুটনিক-ভি টিকাটিও এক কোটি ডোজ কেনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে ২০ লাখ ডোজ করে সরবরাহ নেয়া যেতে পারে। তবে এরপর প্রয়োজনে উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এ টিকা ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
দুটি টিকার ক্ষেত্রেই অর্থ বিভাগের মতামত হলো ঋণপত্রের মাধ্যমে প্রত্যেক চালান জাহাজীকরণের আগে এর অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করা যেতে পারে। বাকি অর্ধেক পরিশোধ করা হবে চালান ঢাকায় পৌঁছার পর।
মার্চের পর এখন পর্যন্ত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কোনো টিকা পাওয়া যায়নি। ফলে টিকার প্রথম ডোজ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাড়ে ১৪ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না। এ অবস্থায় টিকা ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন উৎসে যোগাযোগ করছে সরকার। এর মধ্যে মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি স্পুটনিক-ভি ও বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্ট উৎপাদিত সিনোফার্ম টিকার জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
চীনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ টিকাও এরই মধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাশিয়া ও চীনের টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। দেশ দুটির বিশেষজ্ঞরা দেশে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই শেষে চুক্তি করলে তবেই উৎপাদনে যাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে সময় লেগে যেতে পারে আরো ছয় মাসের মতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকার জন্য এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকার ডোজ ক্রয়ের চুক্তি করছে সরকার। এক্ষেত্রে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা ক্রয়ের বিড়ম্বনার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে।
জানা যায়, টিকা ক্রয় বাবদ অর্থের মধ্যে অগ্রীম ৫০ শতাংশ ও বাকি ৫০ শতাংশ অর্থ টিকা বুঝে পাওয়ার পর এলসির মাধ্যমে পরিশোধ করা যেতে পারে। যেহেতু সরকার এ টিকা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না, তাই ক্লজ ৪.১ এ বর্ণিত ০.১ শতাংশ রয়ালটি পরিশোধের বিষয়টি বাদ দেয়া যেতে পারে। তবে টিকার মূল্য (ক্লজ ২.৬ এ উল্লিখিত) কত হবে তা স্বাস্থ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে পারে।
এদিকে রাশিয়ার করোনাভাইরাস টিকা স্পুটনিক-ভি ক্রয়ের বিষয়ে ২৯টি সুপারিশসহ চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এসব শর্ত অনুযায়ী রাশিয়া টিকা দিতে না পারলে অর্থ ফেরত দেবে। সেইসঙ্গে কোনো জটিলতা হলে দায় হবে দেশটির সরকারের।
এছাড়া টিকা নেয়ার পর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের দায়মুক্তির ধারা পর্যালোচনারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে খসড়াটিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিঠির প্রেক্ষিতে এমন মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
এর আগে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনার টিকা ক্রয়ের চুক্তি করেছিল সরকার। কিন্তু ভারত তার পুরোপুরি সরবরাহ করেনি। সেই অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে সার্বিক বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের সমস্যায় পড়তে না হয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখছেন তারা। ভারতের টিকা না পেলে যে আগাম টাকা দেয়া হয়েছে সেটি ফেরত পাওয়া নিয়েও চলছে আলোচনা।
এ বিষয়ে গত ৫ মে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, টিকার জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটকে দেয়া আগাম টাকা দেয়া হয়েছিল। সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা আসবে না সেটাও তো আমরা জানি না। আমরা তাদের সাথে কথাবার্তা বলছি। আমরা যখন চূড়ান্তভাবে জানতে পারব যে টিকা আসবে না, তখন চূড়ান্তভাবে এটি নিয়ে কথা বলতে পারব।
তিনি জানান, টিকা না আসলে অবশ্যই টাকা ফেরত পাব। এভাবে কোনো দেশ কোনো দেশের টাকা মেরে দেয় নাকি? আমরা লিগ্যাল ডকুমেন্টের মাধ্যমে চুক্তি করেছি। এটা তো গোপন কোনো কাজ নয়। কাগজপত্রে লেখালেখি হয়েছে, ডকুমেন্ট্রেশন হয়েছে সুতরাং কন্ট্রাক্টচুয়্যাল ডিভিশন তাদেরও আছে আমাদেরও আছে। আমরা চেষ্টা করছি টিকা আনার জন্য। আমরা অন্যান্য সোর্সেও চেষ্টা করছি টিকার জন্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ