প্রায় এক মাস আগে প্রতি ডোজ আট ডলার দামে সরকারকে রাশিয়ান স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিনের দুই কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব দিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। চিঠিও দিয়েছে তিনবার। তবু খুঁড়িয়ে চলা টিকা কার্যক্রম এবং বিদেশি সাহায্যের মুখাপেক্ষী সরকার সেই চিঠির কোন উত্তর দেয়নি। এই চুক্তিটা হলে টিকা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতো না আমাদের। রাশিয়ান এই কোম্পানির সাথে চুক্তি হলে উপকৃত হতো দেশের মানুষ। তবে আমলাদের এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও সংশ্লিষ্টদের লাভের পরিমাণ কিছুটা কমে যেত।
তিনবার চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর নেই
সূত্র মতে, গত ৬ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করে ও তাকে চিঠি লিখে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোভিড সমন্বয়কারীও উপস্থিত ছিলেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, গত ৬ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দেয়ার পর ৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেয়া আরেক চিঠিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালকে রাশিয়ান টিকার বাংলাদেশি ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে এই দুই চিঠির কোনো উত্তর পায়নি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। উত্তর না পেয়ে গত ১৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সেখান থেকেও কোনো উত্তর না পাওয়ায় সর্বশেষ গত ২৪ জুন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউসকে।
গত ৬ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দেয়ার পর ৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেয়া আরেক চিঠিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালকে রাশিয়ান টিকার বাংলাদেশি ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে এই দুই চিঠির কোনো উত্তর পায়নি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। উত্তর না পেয়ে গত ১৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সেখান থেকেও কোনো উত্তর না পাওয়ায় সর্বশেষ গত ২৪ জুন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউসকে।
এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার আসলে তেমন কিছু বলার নেই। আমরা চিঠি দিয়ে সরকারকে বিস্তারিত জানিয়েছি। হ্যাঁ বা না, কোনো উত্তর পাইনি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো আপনারা যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের থেকে জানতেন, তবে, ভালো হতো। কারণ, এই তিন জনের সঙ্গে বৈঠক করেই আমরা টিকা কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেই বৈঠক অত্যন্ত সন্তোষজনক ছিল। তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।’
‘রাশিয়ান ডাইরেক্ট ইনভেস্ট ফার্ম (আরডিআইএফ) তাদের টিকা বিক্রির জন্যে ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে এলএলসি এমইবিটিইএক্সকে নিয়োগ দিয়েছে এবং এলএলসি এমইবিটিইএক্স লিখিতভাবে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালকে বাংলাদেশে তাদের একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। চিঠিতে আমরা এসব সংযুক্তি পাঠিয়েছি। রাশিয়ান কোম্পানির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করিনি, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই কেন?
তবে কেন রাশিয়ান কোম্পানি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ না করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করল, এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আরডিআইএফ যে দেশের সঙ্গে চুক্তি করে, প্রথমে তারা সেই দেশের যেকোনো বেসরকারি এজেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগটা করে। সে কারণে আরডিএফআই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ না করে আমাদের সঙ্গে করেছে। কিন্তু, আমার সঙ্গেই যোগাযোগ করার কী কারণ, সেটা তো আমি বলতে পারব না।’
‘এক বছর আগেও গবেষণায় সহযোগিতার জন্যে আরডিআইএফ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তখন সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের তেমন কোনো আগ্রহ না পাওয়ায় আমি তাদেরকে সরাসরি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেই। সম্প্রতি দেশে স্পুতনিক-ভি অনুমোদন পাওয়ায় তারা আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বহু বছর আগে থেকে, অর্থাৎ সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকে রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। হয়তো আরডিএফের কাছে সেসব তথ্য রয়ে গেছে। সেগুলোর ভিত্তিতে তারা খোঁজ নিয়ে হয়তো মনে করেছে যে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করা যায়, হয়তো তারা আমাদের কাজ সম্পর্কেও জানে। এসব কারণেই হয়তো তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা যোগাযোগ করায় আমি সরকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। যেহেতু বাংলাদেশের এই মুহূর্তে টিকা খুব দরকার।’
খুঁড়িয়ে চলছে গণটিকা কার্যক্রম
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জানিয়েছে, গতকাল বুধবার (১৪ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৯৯ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৭ জন মানুষ ‘সুরক্ষা’ অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ১১ই জুলাই পর্যন্ত কোভিশিল্ড, সিনোফার্ম এবং ফাইজার মিলিয়ে এ পর্যন্ত এক কোটি দুইলাখ ৯৫ হাজার ৩৮২ জন মানুষ টিকা নিয়েছেন।
এই জুলাই মাসের শুরুতে কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে মর্ডানার ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ ডোজ টিকা এসেছে। এর বাইরে সরকার চীনের কাছ থেকে কিনছে দেড় কোটি ডোজ, যার মধ্যে ইতিমধ্যে ২০ লাখ ডোজ টিকা এসে পৌঁছেছে।
পাশাপাশি উপহার হিসেবে চীনের কাছ থেকে সিনোফার্মের ১১ লাখ ডোজ টিকা এসেছে। কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের এক লাখ ডোজ এবং মর্ডানার ২৫ লাখ ডোজ পাওয়া গেছে। সব মিলে দেশে মোট টিকার মজুদ ৫৮ লাখ ৫৪ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি।
এছাড়া দেশে আগে আসা টিকার মধ্যে এই মুহূর্তে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড অবশিষ্ট রয়েছে ৯০ হাজার ৭২ ডোজ। অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার কিছু টিকা অগাস্টে পাওয়ার কথা রয়েছে।
দেশে শুরুতেই অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের প্রস্তুতকৃত কোভিশিল্ড টিকা দেওয়া হয়। তবে ভারত টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে ক্রমেই এ টিকার মজুত কমে আসে। আর তাতে করে গত ২ মের পর টিকার জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।
স্থগিতের আগে কোভিশিল্ড টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জনকে। আর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া সম্পন্ন করেছেন ৪২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩ জন। বাকীরা এখনও দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় রয়েছেন।
পরে চীনের সঙ্গে টিকার জন্য নতুন করে চুক্তি এবং কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় ফাইজার-বায়োএনটেকের এবং মডার্নার টিকা আসায় আবার নিবন্ধন শুরু হয় গত ৭ জুলাই থেকে। গত ১২ জুলাই জেলা-উপজেলা পর্যায় চীনের সিনোফার্মের টিকা আর দেশের ১২ সিটি করপোরেশন এলাকায় মডার্নার টিকা দওয়ার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি ফের শুরু হয়েছে।
এই চুক্তিতে উপকৃত হতো দেশের মানুষ
রাশিয়ান কোম্পানির সাথে চুক্তির প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একই গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চুক্তি সাপেক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই তারা এক কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে। আর এক মাসের মধ্যে আরও এক কোটি ডোজ। রাশিয়ার চার্টার্ড প্ল্যানে প্রতিদিন পাঁচ লাখ ডোজ করে ভ্যাকসিন ঢাকায় পৌঁছাবে। প্রতি ডোজের দাম পড়বে আট ডলার। ভবিষ্যতে চাইলে এই দাম আরও কমানোর আলোচনা করা যেতে পারে।’
‘দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে রাশিয়া বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনেও সহায়তা করতে আগ্রহী হবে। কিন্তু, যদি দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তাহলে বর্তমানে যে দামে তারা দিতে চাইছে, তা ধরে রাখাও কষ্টকর হবে। কারণ, সারাবিশ্বে বর্তমানে টিকার চাহিদা খুব বেশি। একইসঙ্গে দ্রুত টিকা পাওয়ায় নিশ্চিত করা যাবে না।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের লাভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো লাভ নেই। কিছু আর্থিক লাভ হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের। আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের লাভ মানে দেশের গরিব মানুষের লাভ। গরিব মানুষের জন্যে কাজ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে দেশ ও দেশের জনগণ। টিকা ছাড়া স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে না। চীনের টিকার চেয়েও দুই ডলার কমে সরকার যদি রাশিয়ান টিকা না কিনতে চায়, আমাদের কিছু করার নেই, বলারও নেই। আমাদের টিকা দরকার কোটি, কিনছি লাখ—এভাবে তো হবে না। গণটিকা দেওয়া যাবে না।’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘অবশ্যই যায়। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আমাকে দায়িত্ব দিলে রাশিয়ান টিকা দেশে উৎপাদনের অনুমোদন এনে দিতে পারব। ড. ইউনূসকে দায়িত্ব দিলে তিনি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অনুমোদন এনে দিতে পারবেন। কিন্তু, সিদ্ধান্ত তো সরকারকে নিতে হবে। আমরা বারবার চিঠি লিখছি, তার উত্তরই দিচ্ছে না সরকার!’
যদিও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জানি না। এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২৩৭
আপনার মতামত জানানঃ