গাজায় গত সোমবার রাত থেকে ইসরাইলের বিমান হামলায় ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন— হামাসের দুই শীর্ষ নেতাসহ ৩৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকশ’ ফিলিস্তিনি। ইসরাইলের ওই বর্বর হামলার প্রতিশোধ নিতে সোমবার রাত থেকে দফায় দফায় সহস্রাধিক রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে হামাস। খবর আনাদোলু ও টাইমস অব ইসরাইলের।
হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে ইসরাইলের আইরন ডোম
ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া উত্তেজনার মধ্যে ইসরাইলে ৫০০শ’র অধিক রকেট ছুড়েছে ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা ইযাদ্দিন কাসসাম ব্রিগেড। এতে অন্তত তিনজন ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক ডজন। এছাড়া, কয়েকটি অবৈধ বাড়ি ধ্বংস এবং একটি তেল শোধনাগারে আগুন ধরে গেছে।
হামাসের বরাত দিয়ে ফিলিস্তিন ইনফরমেশন সেন্টার জানিয়েছেন, গাজা থেকে ইসরাইলের আশদোদ এবং আশকেলন শহরে হামাস ব্যাপকভাবে রকেট হামলা চালিয়েছে। মাত্র পাঁচ মিনিটে এই দুই শহরে ১৩৭টি রকেট হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরাইলের দুই শহরের বিরুদ্ধে এটি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় হামলা বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেছে হামাস।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, গাজা থেকে অন্তত ৫০০টি রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০০টি রকেট ঠেকিয়ে দিয়েছে দেশটির অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস দাবি করেছেন, রকেটগুলোর বেশিরভাগই আইরন ডোম মিসাইল সিস্টেম প্রতিরোধ করেছে।
আজ জাজিরা জানিয়েছে, আয়রন ডোম অতিক্রম করে একটি রকেট ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবের হোলান এলাকায় আঘাত হেনেছে। তেল আবিবে একজন নারী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। এসময় সাইরেনের শব্দে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে থাকেন।
ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম ভেদ করে হামাসের রকেট আছড়ে পড়ছে তেলআবিবসহ ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে। এতে কমপক্ষে ৫ ইসরাইলি নিহত এবং কয়েকশ’ আহত হয়েছে।
হামাসের রকেট হামলায় প্রাণভয়ে দ্বিগবিদ্বিগ ছুটছে ইসরাইলিরা। বুধবার ভোরে ইসরাইলের লড শহরে বাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকা দুই ইসরাইলি রকেট হামলায় নিহত হয়েছেন।এসময় তাদের গাড়িটি রকেট হামলায় উড়ে যায়।
এর আগে হামাসের রকেট হামলায় মঙ্গলবার ইসরাইলেরর দক্ষিণাঞ্চলের আশখেলন শহরে দুই নারী নিহত হয়েছেন। এছাড়া তেলআবিবে হামাসের রকেট হামলায় ৮০ বছরের ইসরাইলি এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত হামাসের হামলায় ৫ ইসরাইলি নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সোমবার রাত থেকে হামাস ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে কমপক্ষে ১০৫০টি রকেট হামলা চালিয়েছে।
ইসরাইলের দাবি, এ সব হামলার ৮০ শতাংশই প্রতিহত করেছে তাদের আয়রন ডোম এবং বাকি দুই শতাধিক রকেট বিভিন্ন স্থাপনা ও স্থানে হামলা চালিয়েছে।
এই প্রথম ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমকে ব্যর্থ করে হামাসের এতা সংখ্যক রকেট ইহুদিদের শহরে হামলা চালাতে সক্ষম হলো।
এর ফলে হামাসকে নিয়ে নতুন করে চিন্তায় পড়েছে ইসরাইল।তাদের আয়রন ডোম নিয়ে এতো দিনের দম্ভ চূর্ণবিচূর্ণ করে একের পর হামলা চালাচ্ছে হামাসসহ ফিলিস্তিনের অন্য প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠনগুলো।
তেল আবিবে রকেট হামলা
হামাসের এই লাগাদার রকেট হামলায় বিধ্বস্ত ইসরাইলের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর তেল আবিব। হামাসের লাগাতার নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে ইসরাইলের আইরন ডোম।
মঙ্গলবার একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে সেখানে। শহরটিতে বেজেছে সাইরেন সতর্কতা। সাইরেনের শব্দে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ইসরাইলেদের পালাতে দেখা গেছে। হামাসের এই রকেট হামলার কারণে তেল আবিবের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করেছে ইসরাইল।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, রকেট হামলার ঘটনায় ইসরাইলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেন গুরিওন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরটি তেল আবিবের পাশেই অবস্থিত।
অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) খবরে বলা হয়েছে, হামাসের কয়েক শতাধিক রকেট হামলায় ইসরাইলেরর দক্ষিণাঞ্চলের আশখেলন শহরে দুই নারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অনন্ত ১০ আহত হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের গণমাধ্যম ডেইলি সাবা বলেছে, হামাসের রকেট হামলায় ট্রান্স-ইজরাইল পাইপলাইন ও তেল শোধনাগারে বিশাল অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। কয়েকটি অবৈধ বাড়ি ধ্বংস হয়েছে।
চ্যানেল ১২ টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, আশকেলন শহরের পার্শ্ববর্তী স্থান মেডিটেরানিয়ান সিটিতে হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখা দেখা দেয়। চারিদিক দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। শহরটি তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, হামাসের ছোড়া রকেটের আঘাতে ইসরাইলের বেশ কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আশকেলন শহরে একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং বেইত নেকোফা এলাকায় একটি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলের আশখেলন শহরে দুই নারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অনন্ত ১০ আহত হয়েছেন।
পাল্টা হামলার বিষয়ে হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডস বলেছে, গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলায় ১২ তলা ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ হামলার প্রতিশোধ নিতে তেল আবিবের দিকে ১৩০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে তারা।
আগ্রাসন বন্ধ না হলে ইসরাইলে রকেট হামলা অব্যাহত রাখবে হামাস
ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ না হলে হামাসের রকেট হামলা চলবে বলে হুশিয়ার করে দিয়েছেন ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া।
তিনি বলেছেন, ইসরাইল যদি পবিত্র জেরুজালেম আল-কুদস শহর এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদে হামলা বন্ধ না করে তাহলে হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলকে লক্ষ্য করে রকেট হামলা অব্যাহত রাখবে।
মঙ্গলবার ইসমাইল হানিয়া বলেন, জেরুজালেম আল-কুদস রাজনৈতিক এবং সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের এই ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ়চেতা মনোভাব চূড়ান্ত বিজয় এনে দেবে বলে আশা করেন তিনি।
হানিয়া স্পষ্ট করে বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত দখলদার ইসরাইল আল-কুদস শহরে তার সব আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড এবং আল-আকসা মসজিদে হামলা বন্ধ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলবে।
ইসরাইলের পাল্টা আক্রমণ
হামাসের রকেট হামলার পর মঙ্গলবারও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বোমা হামলা চালায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। এতে কমপক্ষে ২৮ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নিহত ২৮ ফিলিস্তিনির মধ্যে বেসামারিক নারী ও শিশু রয়েছে। হামলায় অন্তত ১২২ জন আহত হয়েছে।
গত সোমবার থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি দখলদার বাহিনী বিমান হামলা চালায়। সেই হামলা এখনও অব্যাহত রেখেছে তারা।
সোমবার সকালে একদল ইসরাইলি সেনা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আল-আকসায় ঢুকে পড়ে।এসময় ফিলিস্তিনিরা তাদের বাধা দিলে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ইসরাইলি বাহিনী। নামাজরত ফিলিস্তিনিদের ওপর রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে অনেকে আহত হন।
এর জবাবে সোমবার বিকালে গাজার হামাস অধ্যুষিত উপকূলবর্তী এলাকা থেকে ইসরাইলের দিকে রকেট হামলা চালানো হয়।
এরপর সন্ধ্যার দিকে ইসরাইলের বিমানবাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। এতে ৯ জন শিশুসহ ২৪ জন নিহত হয়। এ সময় বিভিন্ন স্থাপনাসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এরপর গাজা উপত্যকায় একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। অনেক বহুতল ভবন ভেঙে চুরমান করে দেওয়া হচ্ছে। এতে এখন পর্যন্ত ১০ শিশুসহ ৩৫ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
অব্যাহত উত্তেজনা নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসলেও ইসরাইলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতিতে দিতে পারেনি সংস্থাটি।
পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকেই জেরুজালেমের অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণ ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছে। গত শুক্রবার জুম’আর নামাজের পর থেকে জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ইসরাইলি পুলিশ এবং সেনাবাহিনী তাণ্ডব চালায়। এরপর দুই পক্ষের সংঘর্ষে বহু হতাহত এবং বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। শত শত ফিলিস্তিনিকে বন্দি করে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী।
সোমবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় আল আকসা মসজিদ থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার আল্টিমেটাম দেয় ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামীরা। এই আল্টিমেটাম আমলে না নেওয়ায় সন্ধ্যা ৬টার পরপরই গাজা থেকে অধিকৃত জেরুজালেম লক্ষ করে সাতটি রকেট ছোড়া হয়। এর জেরে গাজার ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। গাজা থেকেও ধাপে ধাপে রকেট ছোড়া হয় ইসরাইলে বিভিন্ন শহরে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/ ১৩৩৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ