এদেশে ব্যাংক থেকে উধাও হয়ে যায় কোটি কোটি টাকা, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে, পদ্মাসেতু নির্মাণে খরচ হয়ে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা। শুনলে অবাক হবেন, গত দুই দশকে ‘বাংলাদেশের ফুসফুস’ সুন্দরবনে এ নিয়ে ২৩ বার আগুন লেগেছে। তবু সংলগ্ন এলাকার প্রায় শুকিয়ে যাওয়া খাল খননে নেই কোন অগ্রগতি। অথচ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্নীতি হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। যে টাকা দিয়ে অন্তত ৩ বার সুন্দরবনে আগুন লাগা প্রতিহত করতে খাল খনন করা যেতো। তাহলে আমাদের হারাতে হতো না ৭১ একর বনভূমি।
আবারও আগুন সুন্দরবনে
আগুন সম্পূর্ণ নেভানো হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ দাবি করলেও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ২৪ নম্বর কম্পার্টমেন্টে আবারও আগুন দেখা যাচ্ছে আজ বুধবার।
এর আগে, গত সোমবার সকালে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার অন্তর্গত সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি টহল ফাঁড়ি এলাকা ২৪ নম্বর কম্পার্টমেন্টে আগুন লাগে। বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় মানুষের চেষ্টার পর গতকাল দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেল আগুন সম্পূর্ণ নেভানো যায়। এখনও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
তবে বিক্ষিপ্তভাবে বনের এই অংশে ধোঁয়া দেখা যাওয়ায় আজ বুধবার সকালে বন বিভাগ ও শরণখোলা ফায়ার সার্ভিস আবার আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে।
আগুনের কাছাকাছি নেই পানির উৎস
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বাগেরহাট স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. গোলাম ছরোয়ার বলেন, ‘সকাল থেকেই বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। তবে আগুন সেভাবে ছিল না। দুপুরের দিকে হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন স্থানে আবারও আগুন জ্বলে উঠেছে। দুপুর থেকে শরণখোলা ছাড়াও আমাদের মোরেলগঞ্জ ও সদরের ২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছে।’
গোলাম ছরোয়ার আরও বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই আগুন জ্বলছে। একেক স্থান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমরা পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। এখানে অবস্থা তুষের আগুনের মতো। জ্বলছে, নিভছে, আবার জ্বলছে। এখন নিয়ম হলো পানি দেওয়া। আমরা পর্যাপ্ত পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
‘তবে বিপদটা হলো মাটির ওপর যে শুকনো পাতাগুলো আছে, এর নিচে সুড়ঙ্গপথের মতো। তল থেকে আগুন ছড়াচ্ছে। সেভাবে দেখা না গেলেও ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকনো পাতার মাঝে আগুন নিচ থেকে ছড়াচ্ছে। আগুনের খুব কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় ভোলা নদী থেকে ২৫টি পাইপ লাগিয়ে আগুনের ওই স্থানে পানি নিতে হচ্ছে।’
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে মরা ভোলা নদী পার হলেই সুন্দরবন। নদী তীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের দাসের ভারানী টহল ফাঁড়ি। ওই টহল ফাড়ি থেকেও বেশ দূরে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুন নেভাতে দক্ষিণ রাজাপুর, মাঝেরচর ও রসুলপুর গ্রামের শতাধিক গ্রামবাসী যোগ দেন।
কয়েকজন গ্রামবাসী বলেন, এখানে কাছাকাছি কোনো পানির উৎস নেই। এ কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। প্রায় দুই একর এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ছড়িয়ে গেছে। শুকনো পাতার মাঝ থেকে এক এক স্থানে হঠাৎ করে ধোঁয়া ও আগুন দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, এখন বৃষ্টি ছাড়া এই আগুন নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন। ফায়ার সার্ভিস মাত্র একটি পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছে। পানির উৎস দূরে হওয়ায় একাধিক পাইপ দিয়ে চারপাশ থেকে পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এ করণে আগুন দ্রুত ছড়াচ্ছে।
দুই দশকে ২৩ বার আগুন, পুড়েছে ৭১ একর বনভূমি
সুন্দরবনে গতকাল সোমবার আগুন লাগার ঘটনা নিয়ে গত প্রায় দুই দশকে ২৩ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর আগের ২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ‘৭১ একর’ বনভূমির নানা গাছ, গুল্ম-লতা পুড়ে গেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের নথি থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দুবার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার এবং সবশেষ চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২২ বারের অগ্নিকাণ্ডে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনজ সম্পদ (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতা-গুল্ম) পুড়ে যায়, যার আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা বলে বন বিভাগ জানিয়েছে।
কেন বারবার পুড়ছে সুন্দরবন?
এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের গঠিত তদন্ত দল নাশকতা, অসচেতনতা, অবহেলায় ফেলে দেওয়া বিড়ি বা সিগারেটের আগুনকে দায়ী করেছে।
বনসংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা জানান, দীর্ঘদিন খনন না হওয়ায় ভোলা নদী মরে গেছে। শীত মৌসুম এলে এই নদী শুকিয়ে যায়। ফলে স্থানীয় লোকজন অবাধে সুন্দরবনের প্রবেশ করতে পারে। এখানকার কিছু অসাধু মানুষ বনে ঢুকে বুঝে না বুঝে বনজ সম্পদের ক্ষতি করে থাকে। ভোলা নদী খনন না করলে স্থানীয় বাসিন্দারা আরও বেশি বেশি বনে ঢুকবে এবং বনের ক্ষতি করবে বলে তারা মনে করেন।
জানা যায়, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ সংলগ্ন লোকালয় হলো বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলা। এই তিন উপজেলার বনসংলগ্ন গ্রামের মধ্যে রয়েছে ধানসাগর, জিউধরা, বৌদ্ধমারী ও কাটাখালী। এখানে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস।
এই এলাকার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ভোলা ও খড়মা নদী। নদীর ওপারেই সুন্দরবন। এখন নাব্যতা হারিয়েছে এই নদী দু’টি। শীত মৌসুম এলে নদী শুকিয়ে হাঁটু পানি হয়ে যায়। ফলে বন সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করা মানুষ হেঁটে সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে।
এছাড়া বনকে সুরক্ষা দিতে বন ব্যবহারকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বন-সংলগ্ন মরে যাওয়া নদ-নদী খনন এবং সীমান্ত এলাকায় বেড়া ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটিগুলো।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে বন বিভাগ, স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীরা বনজ সম্পদ সুরক্ষিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
সরকার চাইলেই বাঁচাতে পারে সুন্দরবনকে
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, বাগেরহাটের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ নিয়ে সুন্দরবন পূর্ব অংশ গঠিত। সুন্দরবনে গত দেড় দশকে ২২ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই চাঁদপাই রেঞ্জে ঘটেছে।
এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বনবিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই তদন্ত কমিটি বনজ সম্পদ রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে নানা সুপারিশ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এই সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বন সংলগ্ন মরে যাওয়া নদ-নদী খনন, সীমানা রক্ষা বেড়া এবং ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা।
সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
বেলায়েত হোসেন আরও বলেন, গত জানুয়ারিতে মরে যাওয়া ভোলা, খড়মা ও আড়ুয়ার খাল খনন করতে ১৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে ২৩ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার অংশ খনন করা হবে। খুব শিগগির দরপত্র আহ্বান করে এই তিনটি খালের খনন কাজ শুরু হবে।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ করা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বনের অগ্নিকাণ্ড কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমবর্ধমান এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি ধ্বংসের কারণে ইতোমধ্যে বন্যপ্রানীর ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও প্রায় ৩০টি প্রজাতির অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে রয়েছে, যা বনকেন্দ্রিক জীবনচক্র ও বাস্তুসংস্থানের জন্য অশনিসংকেত। তাই এখনি সুন্দরবনসহ অন্যান্য পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও নির্মানাধীনসহ সকল শিল্প ও কারখানা বন্ধ করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষা প্রদানকারী বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পরিবেশ আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনে নাব্যতা হারানো নদী ও খালগুলো দ্রুত খননের ব্যবস্থাসহ সীমানা রক্ষা বেড়া এবং ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ