নিজস্ব মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)। তবে ব্যাংকটি হবে ভার্চুয়াল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে জামানতবিহীন ঋণ বিতরণ হবে এ ব্যাংকের মূল কাজ।
তবে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সে বিষয়ে কিছুই জানেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আজ বুধবার(২৮ এপ্রিল) ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এফবিসিসিআই থেকে আমার কাছে কোনো প্রস্তাব আসেনি। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করেনি, কোনো আলোচনাও করেনি। এ সম্বন্ধে আমি জানি না। যখন জানব, তখন বলব।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই গত রোববার পর্ষদ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আইনশৃঙ্খলা, সশস্ত্র ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তিনটি ছাড়া বেসরকারি খাতের প্রায় সব ব্যাংকের মালিকই ব্যবসায়ী। সেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এখন নতুন করে আবার ব্যাংক করতে চায়। নিজেদের সদস্যদের এতগুলো ব্যাংক থাকার পরও এবং বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে কেন এফবিসিসিআইয়ের ব্যাংক ব্যবসায় নামার প্রয়োজন দেখা দিল, সেটি নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচনা শুরু হয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও।
অবশ্য শুধু ব্যাংক নয়, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালও করতে চায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। গত রোববার অনলাইনে অনুষ্ঠিত সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার আগেই সরকারের উচ্চমহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এফবিসিসিআইয়ের শীর্ষ নেতৃত্বের। সেখান থেকে ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার পরই পর্ষদ সভায় অনুমোদনের জন্য তা প্রস্তাব আকারে তোলা হয়।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবিত ব্যাংকটি ভার্চুয়াল হবে। বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর সরকারের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হবে। প্রচলিত ব্যাংকিং আইনকানুন অনুসরণ করেই এটি পরিচালিত হবে।’
ডিরেক্ট ব্যাংক বা ভার্চুয়াল ব্যাংক হলো এমন একধরনের ব্যাংক যার কোনো শাখা নেই, অনলাইনে বা টেলিফোনের মাধ্যমে বা স্বতন্ত্র ব্যাংকিং এজেন্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এর পরিষেবা দেওয়া হয়। এটিএম, মেইল ও মোবাইল এক্সেসও দেওয়া হতে পারে। ব্যাংকের শাখা পরিচালনার খরচ কমে আসে এ ধরনের ব্যাংকিং সিস্টেমে।
এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘অনেক সংস্থারই তো ব্যাংক আছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেই। এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন, তাদের একটা ব্যাংক থাকতেই পারে। এই ধারণা থেকেই একটি ভার্চ্যুয়াল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তোলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ব্যাংকের বোর্ডে কারা থাকবেন, সেটি সংগঠনের সাবেক সভাপতিরা বসে ঠিক করবেন।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বিতরণের উদ্দেশ্যে শতভাগ কোম্পানি হিসেবে বেসিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সরকার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটি সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। তবে আবদুল হাই বাচ্চু ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি, ভুয়া নিয়োগসহ বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে এটি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ, আনসার-ভিডিপিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা পৃথক ব্যাংকের লাইসেন্স পেলেও কোনো ব্যবসায়ী সংগঠনের মালিকানায় দেশে কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ৬১টি ব্যাংক চালু আছে। এর মধ্যে ৪৩টি ব্যাংকের মালিক ব্যবসায়ীরা। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সালমান এফ রহমান বর্তমানে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এ কে আজাদ শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক, মীর নাসির হোসেন ইস্টার্ণ ব্যাংকের পরিচালক এবং আবদুল আউয়াল মিন্টু ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ফলে এফবিসিসিআইয়ের মালিকানাধীন নতুন ব্যাংকের ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ২০১২ সালে ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া নিয়ে দ্বিমত ছিল। অর্থনীতিবিদেরাও এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারপরও অনুমোদন পাওয়া সব ব্যাংকই পান সরকার-সমর্থিত ব্যক্তিরা। এরপর একে একে অনুমোদন দেওয়া হয় সীমান্ত ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংক। এ ছাড়া পিপলস ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। সব ব্যাংকই অনুমোদন পাচ্ছে সরকারের বিশেষ নির্দেশে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বাংলাদেশে অর্থনীতি ও দেশের আকার বিবেচনায় যত ব্যাংক দরকার ছিল এরই মধ্যে তার চেয়ে বেশি ব্যাংক হয়ে গেছে। দেশে যাদের ক্ষমতা আছে, তারাই এখন ব্যাংকের মালিক। ব্যাংক পাওয়া এখন রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতির অংশ হয়ে গেছে। অর্থনীতির চাহিদা বিবেচনায় নতুন কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তবে এফবিসিসিআই ব্যাংক পেয়ে গেলে অবাক হব না। কারণ, এফবিসিসিআই কারা চালায়, এটা সবাই জানে।’
তারা বলেন, ব্যবসা করা এফবিসিসিআইয়ের কাজ নয়। ব্যাংক-বিমার ব্যবসায় নামলে এফবিসিসিআইয়ের মূল কাজ ব্যাহত হবে। ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে ব্যাংক-বিমা চালানো গেলেও সেখানে পদ পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ