বহুমুখী চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে, আরেকদিকে ডলার সংকটে প্রতিদিন কমছে রিজার্ভের পরিমান৷ এছাড়াও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিকট ভবিষ্যতে দূর হবে বলেও মনে হয় না৷ সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷
রেমিটেন্সও কমে যাচ্ছে৷ দ্রব্যমূল্যসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে গেছে৷ ফলে প্রবাসীরা টাকা আগের মতো টাকা পাঠাতে পারছেন না৷ এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হারও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হার কম৷ ফলে অনেকে ‘ইনফরমাল চ্যানেল’ বা অনানুষ্ঠানিক পথে টাকা পাঠাচ্ছেন৷ এসব কারনে রেমিট্যান্স কমছে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের৷
এমন পরিস্থিতিতে সরকার গত ২৪ জুলাই সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার চেয়ে আইএমএফকে চিঠি দেয়৷ ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট বা লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাজেট সহায়তা বাবদ জরুরি ভিত্তিতে অর্থ চাওয়া হয় ঐ চিঠিতে৷
সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌঁছানোর পর গতকাল অর্থ সচিবের সাথে সচিবালয়ে বৈঠক করেন৷ আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে৷ আইএমএফ এর এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান রাহুল আনন্দ দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ ৯ নভেম্বর পর্যন্ত তারা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সাথে বৈঠক করবেন৷
এছাড়াও প্রতিনিধি দল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আরও কিছু দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবেন৷ সর্বশেষ তারা বৈঠক করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে৷
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) বাবদ ১৫০ কোটি ডলার ও বাজেট সহায়তা বাবদ ১৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে৷ বাকি ১৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে সংস্থাটির আরএসটিএফ (সহনশীলতা ও টেকসই সহায়তা তহবিল) থেকে৷
এর আগে আইএমএফ ২১ অক্টোবর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, তাদের এবারের ঢাকায় আসা মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের সংস্কার ও নীতি নিয়ে আলোচনার জন্য৷ সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কর্মকর্তা পর্যায়ে চুক্তির অগ্রগতির জন্য আলোচনা করা৷ আলোচনা হবে আইএমএফের বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) কর্মসূচি এবং নতুন উদ্যোগ, আরএসটিএফ কর্মসূচি থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে৷
আরএসটিএফ ঋণের অধীনে সাশ্রয়ী ও দীর্ঘ মেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোকে অর্থায়ন করা হয়৷ আইএমএফ এর কাছে ঋণের জন্য চাওয়া চিঠিতে এই আরএসটিএফের কথাও উল্লেখ করেছিল সরকার৷
মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর কাছ থেকে দ্রুত ঋণ সহায়তা নিয়ে চলমান সংকটের লাগাম টেনে ধরতে চায় সরকার৷ তবে অর্থমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদেরা৷
তারা বলছেন, সংকট সমাধানে যখন বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা হিমশিম খাচ্ছেন তখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না৷ তিনি অনেকটা অদৃশ্য৷ তার কোন সক্রিয় ভূমিকা নেই৷ অথচ তার উচিত ছিল সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করা৷
তাদের মতে, অর্থমন্ত্রী নিস্ক্রিয় থাকলে কোন বিষয়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না৷ এর ফলে কালক্ষেপণ হয়, যার ফলাফল কখনোই ভাল হয় না৷
তবে অর্থমন্ত্রী কেন নিস্ক্রিয়, তিনি কেন অফিসে নিয়মিত আসেন না বা গুরুত্বপূর্ণ সভায় অনুপস্থিত থাকেন না তা জানা সম্ভব হয়নি৷ যদিও অনেকে বলছেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে দেখা যাচ্ছে না, তিনি বাসায় বসেই অনেক কাজ করেন৷
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা৷ আর অর্থমন্ত্রী থেকেও নেই৷ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়, আর সেটা করেন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয়৷ আমি সেরকম কিছু দেখছি না৷
তার মতে, দেশের অর্থনীতি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের টিম লিডারের কাছ থেকে খুব দৃশ্যমান, সক্রিয় ভূমিকা দরকার৷ অন্য যেসব দেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যেখানে অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ৷
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমাদের দেশে যে যার মত কাজ করছে, কোন সমন্বয় নাই৷ এটা হতে পারে না৷ সমস্যা চিহ্নিত করে একটা কৌশল থাকা উচিত৷ কিন্তু বিদ্যুতের কী সমস্যা আমরা এখনও জানি না৷ আমরা জানি সরকারের টাকা নাই তেল কেনার৷ কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য কত লাগবে জানি না৷ আবার তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের লোকেরা জানে না৷ সর্বত্র চরম সমন্বয়হীনতা৷”
আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী নিস্ক্রিয় থাকলে কোন কিছুই ঠিক মত হয় না৷ সব কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবে হয়৷ ফলে ফলাফল আশানুরুপ হবে না৷
অনেকটা একই সুরে কথা বলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন৷ তিনি বলেন, দিন শেষে অর্থ মন্ত্রণালয় হচ্ছে সরকারের লিড এজেন্সি৷ বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের কাউন্টার পার্ট হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রী যাদের সাথে ডিল করে৷ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিস্ক্রিয় থাকলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে।
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অর্থ সচিব বা গভর্নর প্রাথমিক কাজগুলো করে দিতে পারেন৷ কিন্তু সিদ্ধান্তটা উপর থেকে নিতে হবে৷ এছাড়াও যদি আরও উপরের লেভেলে যেতে হয় (প্রধানমন্ত্রীর কাছে) সে ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে৷ তাই তিনি যদি নিস্ক্রিয় থাকেন তাহলে সবকিছু ব্যাহত হবে৷
সমন্বয়হীনতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে৷ কিন্তু সেটা কতখানি মেনে চলা হচ্ছে পরিস্কার না৷ ডলারের বিভিন্ন মিনিময় হার একটা বড় সমস্যা৷ একই মুদ্রার এতগুলো দর হতে পারে না৷ অন্যদিকে সরকার প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ব্যয় করছে৷ আবার ডিজেল কিনতে পারছে না বলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না৷ ডিজেল ও গ্যাসের সংকটের কারনে লোডশেডিং করা হচ্ছে৷ এসব থেকে কি ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে তা পরিস্কার না৷”
দুই অর্থনীতিবিদ মনে করেন আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ নেয়া সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত৷ সরকার নভেম্বর মাসের মধ্যে ঋণ পেতে চাইলেও এত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে বলে মনে করেন না তারা৷
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘প্রথম কিস্তির ঋণ পাওয়ার ব্যাপারটা এখনো অনেক দূরের বিষয়৷ মিশন তো কেবল মাত্র আসলো৷ ঋণ পেতে গেলে কোন কোন খাতে কী করতে হবে তা দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত লোন সমঝোতায় পৌঁছানো যাবে না৷ চুক্তি হলে তারপর আইএমএফ এর বোর্ডে তা পাশ হতে হবে৷”
তবে তিনি বলেন, সরকার আশা করছে এই অর্থ বছরের মধ্যে অন্তত একটা কিস্তি পাবে৷ কী করতে হবে এটা যদি ঠিক হয় তাহলে পরের পদক্ষেপগুলো দ্রুত হতে পারে৷ কিন্তু কী করতে হবে এটা যদি নির্ধারিত না হয়, তাহলে বলা মুশকিল কয় মাস লাগবে৷
ঋণের বিষয়টা চূড়ান্ত হয়ে গেলে সেটা একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি৷ তবে ঋণের যে পরিমান তা দিয়ে মাত্র চার মাস চলা সম্ভব৷ তাই সরকার ঋণ নিয়ে কী কী কাজ করবে তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে৷
আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, প্রথম কিস্তি ঋণ পেতে জানুয়ারি পর্যন্ত লাগতে পারে৷ তবে সেক্ষেত্রে এই মিশনের সফরের মধ্য সবকিছু চূড়ান্ত করতে হবে৷
আইএমএফ-এর ঋণ নিয়ে সরকার সমস্যা কতটুকু সামাল দিতে পারবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আত্মবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করবে৷ এর ফলে এক ধরনের স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে৷ তবে এর সাথে পলিসি সমন্বয় করতে হবে৷ প্রয়োজনে সুদের হার ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে৷”
তবে তারা দুইজনই মনে করেন, ঋণ পেতে হলে সরকারকে অনেক সংস্কার করতে হবে৷ এর মধ্যে আছে ভ্যাট রেটের সংখ্যা কমানো, ট্যাক্স প্রশাসনে অগ্রগতি আনা, জ্বালানি মূল্যের ব্যাপারে একটা নির্দিষ্ট ফরমুলা ঠিক করা, আর্থিক খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ডে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ