পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার পুরনো কাপড় ব্যবহার করলে জ্বর, তলপেটে ব্যথা ও মূত্রনালিতে সংক্রমণ হতে পারে। এ ছাড়া জরায়ুতে ইনফেকশনও হতে পারে। ইনফেকশন দীর্ঘদিন থাকলে পরবর্তী সময় সেটি জরায়ুর ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এদিকে বাংলাদেশের শহর অঞ্চলে মাত্র ৩৩ শতাংশ নারী প্রতি মাসের পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। যার প্রধান কারণ অতিরিক্ত দাম এবং সচেতনতার অভাব। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের জন্য প্যাড অনেকটা বিলাসিতাই। সেখানে চা বাগানের মহিলা শ্রমিকদের পিরিয়ডের সময়ে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে কথা অনেকটা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন।
শুধুমাত্র স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করার কারণে চা বাগানের নারীরা বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণজনিত রোগে ভোগেন। যদিও নারীদের পিরিয়ডের সময় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু হল স্যানিটারি ন্যাপকিন। কিন্তু স্যানেটারি ন্যাপকিন কেনার ক্ষমতা চা বাগানের নারীদের নেই। তার ওপর রয়েছে সামাজিক সংকোচ ও লজ্জা। যাদের চাল কেনার টাকা নেই, তাদের কাছে প্যাড কেনার গল্প করা রীতিমতো হাস্যকর। ফলে চা বাগানের শ্রমিকদের প্রতি মাসে ৫ দিন, একটা ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
এক প্যাকেট স্যানিটারি প্যাডের দাম যাদের একদিনের ইনকাম
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ছাতি কতটা চওড়া হয়েছে সেটা নিয়ে মাপজোখ সরিয়ে চা শ্রমিকদের কতটা উন্নতি হল সে দিকটা একবার দেখা যাক। বাজারে পণ্যদ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে প্রশ্ন তুললেই সরকারি হোমড়াচোমরা কর্মকর্তারা হয়তো আমাদের মাথাপিছু আয়ের অঙ্কটার সাথে দু’কথাও শুনিয়ে দেবে। কিন্তু সবটাই যে শুভঙ্করের ফাঁকি, তা সবার জানা। এই যেমন দৈনন্দিন মজুরি বাড়ল চা শ্রমিকদের। পুরো ১৮ টাকা। ফলে, বর্তমানে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। এখন দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পাওয়ার জন্য নির্ধারিত ২৩ কেজি চায়ের পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের। আর চা মৌসুমে বাড়তি আয়ের আশায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে শ্রমিকরা ৪০ থেকে ৫০ কেজি চা পাতা উত্তোলন করেন। কিন্তু ২৩ কেজি চা তুললে পান ১২০ টাকা, সেই হিসাবে প্রতি কেজি ৫ দশমিক ২১ টাকার কিছু বেশি হয়। কিন্তু ২৩ কেজির বাড়তি প্রতি কেজির জন্য শ্রমিকরা পান গড়ে মাত্র ৩ দশমিক ৭০ টাকা।
১১০ টাকার যে প্যাডের প্যাকেট পাওয়া যায়, তাতে সাধারণত আটটি প্যাড থাকে। ধরে নিচ্ছি যে নারীর ৯৬ ঘণ্টা রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তার ছয় ঘণ্টা অন্তর প্যাড পরিবর্তন করলে সর্বমোট ১৬টি প্যাড লাগে। যার এই সময় সাত দিন তার লাগে ২৮টি। অর্থাৎ শুধু পিরিয়ড চলাকালেই পিরিয়ডের মূল্য হিসেবে একজন নারীকে পরিশোধ করতে হচ্ছে সর্বনিম্ন ২২০ থেকে ৩৮৫ টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৮ থেকে ১০ টাকায় এক প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়।
এদিকে বাজার ঘুরে দেখা যাচ্ছে, স্কয়ারের ১৫ পিসের এক প্যাকেট সেনোরার দাম ১২০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স ১৬ পিস ১৫০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স আল্ট্রা ৮ পিস ১১০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স সুপার ১০ পিস ১১০ টাকা, সেনোরা স্যানিটারি রেগুলার ১০ পিস ৯০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স রেগুলার ১০ পিস ১১৫ টাকা এবং পাঁচ পিসের দাম ৬০ টাকা। এসিআই লিমিটেডের স্যাভলোন ফ্রিডম কম্বোপ্যাক ১০ পিস ১১০ টাকা, আট পিস হ্যাভি ১১০ টাকা, ১৬ পিস হ্যাভি ২০০ টাকা, ফ্রিডম রেগুলার ১০ পিস ১১০ টাকা, ২০ পিস ২০০ টাকা, এসএমসির জয়া আট পিস ১০০ টাকা। এ ছাড়া সানিডে আট পিস ১৩০ টাকা, হুইসপার ১৩৩ টাকা, সোফি ৭৬ টাকা, স্টেসেফ ১০০ টাকা এবং মোলপেড ২৩৫ টাকা।
১১০ টাকার যে প্যাডের প্যাকেট পাওয়া যায়, তাতে সাধারণত আটটি প্যাড থাকে। ধরে নিচ্ছি যে নারীর ৯৬ ঘণ্টা রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তার ছয় ঘণ্টা অন্তর প্যাড পরিবর্তন করলে সর্বমোট ১৬টি প্যাড লাগে। যার এই সময় সাত দিন তার লাগে ২৮টি। অর্থাৎ শুধু পিরিয়ড চলাকালেই পিরিয়ডের মূল্য হিসেবে একজন নারীকে পরিশোধ করতে হচ্ছে সর্বনিম্ন ২২০ থেকে ৩৮৫ টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৮ থেকে ১০ টাকায় এক প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র। এখানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো বিকল্পহীন মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন কিটের আমদানির ওপর ৪০ শতাংশ ভ্যাট ও ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করারোপ করা হয়। রাষ্ট্র চাইলে এই বোঝা কমাতে পারে।
বিভিন্ন এনজিও দোহাই দিয়ে সরকার কাঁধ থেকে আর সব সমস্যার মতো এটাও ঝেড়ে ফেলতে পারে। সরকার যে কী পারে না, এটাই চিন্তার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে (পঞ্চগড় বাদ দিয়ে) মোট চা–বাগানের সংখ্যা ১৬০। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগর উপজেলার এই চা–বাগান একটি। দেশের মোট চা বাগানের ৯২টি বাগানই মৌলভীবাজার জেলায়। চা বাগানগুলোতে কাজ করা ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি চা–শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে পিরিয়ডকালীন সময়ে স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার নিয়মিত করতে এনজিও এবং ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
এই যেমন নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরামের আহবায়ক মার্জিয়া প্রভা স্টেট ওয়াচকে জানান, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারতে ‘হ্যাপি টু ব্লিড’ আন্দোলনটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে ‘ডোনেট অ্যা প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ’ নামে একটি উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগে প্রথমে তিনি এবং তার দল গণভাবে প্যাড সংগ্রহ করে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে থাকা নারীদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতেন। তারা দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কিছু স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাইজিন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন করেন।
১১ টি স্কুলে ‘ইমার্জেন্সি প্যাড কর্নার’ তৈরি করে দেন। যেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সমবায় পদ্ধতিতে প্যাড ক্রয় ও ব্যবহার করতে পারবে। তবে এর মধ্যে মাত্র দু’টো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মার্জিয়া প্রভার এই উদ্যোগ সফল হয়েছে। একটি নেত্রকোনা সরকারি মহিলা কলেজ, অন্যটি রংপুরের একটি স্কুল।
নেই খাবার পানি, পরিচ্ছন্নতার নাম নেয়াও বারণ
মার্জিয়া প্রভা স্টেট ওয়াচকে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা প্যাড তো দূরের কথা জীবাণুমুক্ত কাপড় ব্যবহারেও সচেতন নয়। তারা নোংরা, ভেজা, স্যাঁতসেঁতে কাপড় ব্যবহার করে। হাইজিন সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান তাদের নেই। অনেকে কাপড় ধুয়ে বাড়ির পুরুষদের সামনে রোদে দিতে লজ্জা পান। তাই কোনরকমে ধুয়ে আধশুকনো কাপড় ব্যবহার করেন। এতে কাপড় পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত হয় না।
কখনো কখনো খুব প্রয়োজন হয়ে গেলে বাগানের কাছের ছড়া বা খালের পানিতে চা শ্রমিকেরা তাদের কাপড় ধুয়ে নিতে বাধ্য হন। নোংরা পানির কারণে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। অথচ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। উপায় থাকলেও জানা নেই। কেউ জানানোর নেই। চা শ্রমিকদের জীবন এই পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেলের বাংলাদেশ থেকে বহুদূর। উন্নয়নের হাততালি যেখানে পৌঁছায়নি। দাসপ্রথা বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে ন্যূনতম সুবিধা থেকেও বঞ্চিত এই নারীদের মাসিকের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়াটা চা বাগানের একটা বাস্তবতা।
চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে জানা যায়, অনেক বাগানে শ্রমিকদের খাল বা ছড়ার পানিও পান করানো হয়। পানি পানের জন্য গ্লাসও দেওয়া হয় না।
স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ব্যবহার করলে এ অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। তবে কারও সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। যে শ্রমিক দৈনিক ১২০ টাকা আয় করে, তার জন্য ১০০ টাকা ব্যয় করা বিলাসিতাই তো। তাই পারে না। ওই টাকায় দু’দিনের খাবার জুটে যাবে। তবে চা বাগানের বেশির ভাগ নারী শ্রমিক স্যানিটারি প্যাডের নামও শোনেনি কখনও। পুরনো কাপড়ের হাইজিন সম্পর্কেও তাদের জানার দৌড় চা বাগান অব্দিই।
কাজের জায়গায় পানির কোন ব্যবস্থা নেই! এই বিভৎসতার কোন নাম দেয়া যায়। মালিকশ্রেণী শ্রমিকদের মানুষ বলেই মনে করছে না। শমসের নগরের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে আসা নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগ যেসব সমস্যা থাকে তা সৃষ্টি হয় পানি কম পান করার জন্য বা মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত পরিচর্যা না করার জন্য। এর মধ্যে ইউরেনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের (ইউটিআই) সমস্যায় বেশি আসেন। সাদা স্রাবেরও সমস্যা আছে। শুধু বাগানের শ্রমিকদের না, অন্য নারীদেরও এ সমস্যা আছে। তবে বাগানের শ্রমিক নারীদের এ সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি।
সিলেট শহরের কাছের তারাপুর, মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা–বাগানের ৮০ নারী শ্রমিকের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, ৯২ ভাগ নারী শ্রমিকই মাসিকের সময় প্যাড ব্যবহার করেন না। তাঁরা সাধারণ কাপড় ব্যবহার করেন। ৭৮ শতাংশ শ্রমিক টয়লেটের পর এবং খাবার রান্নার আগে ভালো করে ধোন না। আর ৫৭ ভাগ নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই।
টিআইবি বলছে, ২৩টি বাগানে কাজের সময় শ্রমিকদের ছড়া, কুয়া বা খালের পানি পান করতে দেওয়া হয়। হাত পেতে শ্রমিকেরা পানি পান করেন, কোনো গ্লাস দেওয়া হয় না। বাগানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শৌচাগার নেই। ১১টি বাগানে চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। ৭৫ শতাংশ শ্রমিককে বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮ শতাংশ শ্রমিক চিকিৎসা নিয়েছেন কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে। মাত্র ২২ শতাংশ শ্রমিক চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা পান।
জরায়ু মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকিতে চা শ্রমিকেরা
চা বাগানে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের প্রাথমিক সনাক্তকরণের ভায়া টেস্টের (ভিজ্যুয়াল ইনসপেকশন অব কারভিক্স উইথ অ্যাকটিভ অ্যাসিড) একটি প্রোগ্রামের কাজে গিয়েছিলেন নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরামের আহবায়ক মার্জিয়া প্রভা। সেখানে তার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। এ প্রসঙ্গে স্টেট ওয়াচকে তিনি বলেন, চা বাগানের মহিলা শ্রমিকেরা স্যানিটারি প্যাড কী সেটাই জানে না। সেখানে মাধ্যমিক পাশ করা একটি মেয়ে প্যাডের নাম পর্যন্ত শোনেনি। চা বাগানে শ্রমিকদের জন্য যে ক্লিনিকগুলো আছে, সেখানে পর্যাপ্ত ও যোগ্য স্বাস্থ্যকর্মী নেই। যারা আছে তারা নিজেরাই মিনস্ট্রেশনকালীন একজন নারীর প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে জানে না।
চা বাগানের মহিলা শ্রমিকেরা স্যানিটারি প্যাড কী সেটাই জানে না। সেখানে মাধ্যমিক পাশ করা একটি মেয়ে প্যাডের নাম পর্যন্ত শোনেনি। চা বাগানে শ্রমিকদের জন্য যে ক্লিনিকগুলো আছে, সেখানে পর্যাপ্ত ও যোগ্য স্বাস্থ্যকর্মী নেই। যারা আছে তারা নিজেরাই মিনস্ট্রেশনকালীন একজন নারীর প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে জানে না।
হবিগঞ্জের চাঁদপুর চা বাগানে ১৫০ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ভায়া টেস্ট করা হলে ২৫ জন পাওয়া যায় যারা জরায়ু মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছে। এরমধ্যে ১৭ জনের জরায়ুমুখ নেমে যাওয়া ছিল। যাদের ভায়া করা সম্ভব হয়নি। সিলেটে খাদিমনগরে ১০০ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ৫৭ জন ভায়া করতে উৎসাহী ছিলেন। এই ৫৭ জনের ১৩ জন ঝুঁকিতে আছেন। এদের মধ্যে ৮ জনের জরায়ুমুখ নেমে গেছে। তাদেরও ভায়া করা সম্ভব হয়নি। হবিগঞ্জের বৈকুন্ঠপুর চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটি জানিয়েছে, তাদের নারীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে চল্লিশের পরে থেকে জরায়ুমুখ নেমে যাওয়া।
খাদিমনগরে পরিস্থিতি অনেকটা মন্দের ভালো। একটি ফার্মেসি আছে সেখানে। যেখানে প্যাড বিক্রি হয়। সিলেট সদরের কাছাকাছি থাকার কারণে এখানে টুকটাক প্যাড সম্পর্কে জানা আছে। কিন্তু ব্যবহার নগণ্য। চাদপুর এবং মৌলভী চা বাগানে প্যাড সম্পর্কে ধারণা নেই। প্যাড সম্পর্কে তারা কিছুই জানেনা।
কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। তবে ডাক্তার নেই। প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট নেই। ছোট খাটো সার্জারির জন্যেও রোগীকে সদরে পাঠানো হয়। ডানকান ব্রাদার্সের চা শ্রমিকের জন্য ক্যামেলিয়া হসপিটাল আছে। কিন্তু ছোট সার্জারির জন্য সেখানে পাঠানো হলেও, দূরত্ব এবং যাতায়াত ব্যয়ের জন্য অনেক শ্রমিক যায় না।
এই তিনটি চা বাগানে রোগীদের জন্য কোন এম্বুলেন্স নেই। গাইনী স্পেশালিস্ট কোন ডাক্তার নেই। মেডিকেল এসিস্টেন্ট এবং মিডওয়াইভসদের দিয়েই গাইনী সেবা দেওয়া হয়। অনেকসময় তারাই ওষুধ প্রেসক্রাইব করে। যদিও রেজিস্টার্ড ডক্টর না হলে ওষুধ প্রেসক্রাইবের নিয়ম নেই।
মার্জিয়া প্রভা বলেন, প্রোগ্রামের কাজে ফেনীর মহীপাল গিয়ে দেখতে পাই স্কুল কলেজের অনেক শিক্ষার্থীরা স্যানিটারি প্যাডের বদলে কাপড় ব্যবহার করে। তবে আশার কথা তারা কাপড়ের সঠিক ব্যবহারটা জানে। নতুন বা পুরাতন কাপড় কিন্তু ক্ষতিকর নয়, যদি তা জীবাণুমুক্ত থাকে। প্রত্যেকবার ব্যবহারের পর আপনাকে কাপড়টা সাবান পানি দিতে ধুয়ে ভালো করে রোদে শুকাতে হবে। আমাদের প্রোগ্রামের আওতায় কিছু স্কুলে সার্ভে করে দেখেছিলাম ৬৮ ভাগ নারী প্যাড ব্যবহার করত না৷ তাই কাপড় ব্যবহারে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। না হলে জরায়ু মুখে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
এমনকি শহরগুলোতেও নারীরা পড়ছেন বিভিন্ন সমস্যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। চলতি পথে বাসে ট্রেনে বা যানবাহনে পিরিয়ডের সময় ঘটছে অস্বস্তিকর ঘটনা। এমন এক সমস্যা দেশের পাব্লিক টয়লেটগুলোর বেহাল দশা এবং সেখানে স্যানিটারি প্যাড না থাকা। এ নিয়ে মার্জিয়া প্রভা স্টেটওয়াচকে জানান, ঢাকার তেঁজগাও, গুলশানের মতো আবাসিক এলাকাতে উন্নত পাব্লিক টয়লেট থাকলেও নেই স্যানিটারি প্যাডের সুবিধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং বিমানবন্দরে যদিও প্যাড বুথ থেকে সুলভমূল্যে প্যাড সংগ্রহ করা যায়। তবে এটা পর্যাপ্ত নয়। সরকার এবং বিভিন্ন এনজিওকে এগিয়ে আসতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে সোশ্যাল ওয়ার্কার জান্নাতুল ফেরদৌস স্টেটওয়াচকে বলেন, পিরিয়ডকালীন সময়ে আমরা অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হই। প্রথমত আমাদের দেশের পাবলিক টয়লেটের অবস্থা খুবই নোংরা, প্রয়োজনীয় সুবিধাদি নাই বললেই চলে। এছাড়া এত নোংরা থাকে যা ব্যবহারের একদম অযোগ্য। আর পাব্লিক টয়লেট সব জায়গায় ও এভেইলেবল না। ছেলেরা তাও ওই নোংরা অবস্থায়ই ব্যবহার করলেও মেয়েদের জন্য করা সম্ভব না। পিরিয়ডের সময় তো আরও না।
তাই পরিষ্কারের বিষয় আগে ঠিক না করে স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রোভাইড করা পাব্লিক টয়লেটের ক্ষেত্রে তেমন যুক্তিযুক্ত না। অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধযুক্ত, প্রয়োজনীয় জিনিসের স্বল্পতা (সবসময় পানি সরবরাহ না থাকা, সাবান, টয়লেট টিস্যু)। এসব না ঠিক করে শুধুমাত্র স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করলেও খুব বেশি লাভ নেই। বিপাকে পড়ে হয়ত অনেকে ব্যবহারও করবেন, তবে তাতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুকি থাকে। এছাড়া জরায়ু মুখের নানা রোগ বা ক্যান্সারের সৃষ্টি হতে পারে।
এর চেয়ে ভালো হয় যদি যাতায়াত হয় এমন সব স্থানে মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার সুযোগ করা যায়। তাহলে বাধ্য হয়ে নোংরা পাব্লিক টয়লেট ব্যবহার করতে হয় না। তাছাড়া সব জায়গায় মেয়েদের জন্য এ ব্যবস্থা থাকলে রাস্তাঘাটে মেয়েদের কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না। সাথে স্কুল, কলেজ বা কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময়ে কামাই দিতে হয় না। অধিকাংশ মেয়ে এ সময়ে বাড়ির বাইরে এ কারণেই যায় না। কারণ বাসার মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নাই, টয়লেট নাই। টয়লেট থাকলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের সহজলভ্যতা নাই।
এছাড়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন অনেক সেন্সিটিভ জিনিস। পরিষ্কার জায়গায় রাখতে হয়। পাব্লিক টয়লেট এর ভেতরের অবস্থাই যেখানে এতটা অস্বাস্থ্যকর সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখলে দেখা যাবে পোকা ধরে গেছে বা নোংরা অবস্থায় জীবানু বাসা বেঁধেছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ছয় ঘন্টা পর প্যাড পাল্টানো আর এক রসিকতা
প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জন মেয়ে মারা যায়। একটি প্যাড সারাদিন পরার কারনে। আল্ট্রা ন্যাপকিনে ব্যবহৃত রাসায়নিক যা তরলকে জেলে রূপান্তরিত করে, এটি মূত্রাশয় এবং জরায়ুতে ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো প্রসঙ্গে মার্জিয়া প্রভা স্টেটওয়াচকে বলেন, স্কুল কলেজের অনেক মেয়েই এটা জানে না। কেউ কেউ আট বা দশ ঘন্টা প্যাড ব্যবহার করে। শিক্ষিত কর্মজীবী নারীদের মধ্যেও এ নিয়ে যথেষ্ট অজ্ঞতা রয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন শুধুমাত্র সবস্তরের নারীদের জন্য সুলভ করলেই হবে না, এর জন্য বিভিন্ন এনজিও, সচেতন নাগরিক এবং সরকারের পক্ষ থেকে মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে।
প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো প্রসঙ্গে মার্জিয়া প্রভা স্টেটওয়াচকে বলেন, স্কুল কলেজের অনেক মেয়েই এটা জানে না। কেউ কেউ আট বা দশ ঘন্টা প্যাড ব্যবহার করে। শিক্ষিত কর্মজীবী নারীদের মধ্যেও এ নিয়ে যথেষ্ট অজ্ঞতা রয়েছে।
চা শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সামর্থ্যের কারণে প্যাড ব্যবহার না করতে পারলেও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন সুতির কাপড় ব্যবহার ভালো বিকল্প হতে পারে। কিন্তু সেই কাপড় অবশ্যই ছয় ঘণ্টা পর পাল্টাতে হবে। কারণ, ছয় ঘণ্টা পর জমা রক্ত জীবাণুর বংশ বিস্তারের আদর্শ আধার হয়ে যায়। তখন শরীরের সঙ্গে থাকা জীবাণু মিলে প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটাবে। যাতে তার প্রজননতন্ত্রের প্রদাহ তৈরি করে। পরে তলপেটে ব্যথা, স্বামীর সঙ্গে মেলামেশায় ব্যথা এবং সন্তান ধারণেও অক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে।
তবে বিধি বাম। খেয়ে, না খেয়ে, আধপেটা অবস্থায় সকাল আটটার আগেই বাগানে কাজের জন্য ছুটতে হয়। টানা আট ঘণ্টা কাজ। তবে কাজ সেরে বাসায় ফিরতে ১০ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। ছয় ঘণ্টা পর একজন চা–শ্রমিক যে তার কাপড় পরিবর্তন করবেন, কর্মক্ষেত্রে সেটার জায়গা কোথায়? চা বাগানে একবার কাজ করতে ঢুকলে তার এসব ফুরসত নেই। আবার শুধু কর্মক্ষেত্র না, যে লেবারলাইনে তারা থাকেন, সেখানেও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই।
অথচ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময় প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো প্রয়োজন। অন্যথায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং নানা রোগ দেখা দিতে পারে। ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি পালন না করা ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করায় নারীরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হন। মাসিকের সময় পুরাতন কাপড় বা তুলা ব্যবহারের ফলে লোকাল ইনফেকশন হতে পারে। যৌনাঙ্গে ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। যা ক্রনিক আকার ধারণ করলে তলপেটে ব্যথা, বমি হওয়া বা ভ্যাজাইনোটিস হতে পারে।
সংকোচ আর দ্বিধায় গড়ে ওঠা এক প্রাচীন ট্যাবু
পিরিয়ড নিয়ে বাগানের নারীদের লজ্জার শেষ নেই। সংকোচে গুটিয়ে থাকে। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা সেখানে লজ্জার। স্যানিটারি প্যাড নিয়ে তেমন কোন ধারণা নেই হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতিত। বাগানের নারী চা শ্রমিক কিংবা মেয়ে তাদের নোংরা এবং জরাজীর্ণ কাপড় ব্যবহার করাই একমাত্র উপায়। কিন্তু সেখানেও বাঁধ সাধে গোঁড়ামি। কাপড় ভালো মতো পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত করা খুবই দরকার। সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে রোদের শুকানো উচিত। কিন্তু লজ্জা আর সংকোচে তারা কাপড়গুলো ঠিকমতো রোদেও শুকায় না। অন্য ভেজা কাপড়ের নিচে পুরুষদের চোখের আড়াল করে রোদে দেয়। এরপর ভেজা স্যাঁতসেঁতে কাপড় ব্যবহার করে। এতে বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
তবে শুধু চা বাগানের নারী শ্রমিকদের মধ্যেই নয়। পিরিয়ড বা মাসিকের মত একটা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে লজ্জা আর সংকোচের শেষ নেই আমাদের শিক্ষিত সমাজেও। চুপচাপ কাউকে বসে থাকতে দেখলে, বাইরে বের হতে না চাইলে, টয়লেটে গিয়ে একটু বেশী সময় নিলে বা কোন মেয়েকে ফার্মেসীর দোকানে প্যাড কিনতে দেখলেই কানাঘুষো শুরু হয়, মুখ টিপে হাসে। অনেক বাবা-মাও পিরিয়ডের বিষয়ে সন্তানের সাথে কথা বলতে অস্বস্তিতে পড়েন। এ বিষয়টা নিয়ে মায়েরাই সাধারণত কথা বলেন। যেন বাবার থেকে খুব লুকানোর একটা ব্যাপার এই পিরিয়ড। এখান থেকে পুরুষের চোখ এড়িয়ে এই পাঁচদিন পার করাটা নারী সমাজে মুখ রক্ষার এক হাতিয়ার যেন।
টিভিতে পিরিয়ড সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন এলে তা চট করে সরিয়ে ফেলার অভ্যাসটাও তৈরি হয়ে গেছে আমাদের। মেয়েরাও ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট লুকোচুরি করে। কোন সমস্যা হলেও ডাক্তারের কাছে যেতে লজ্জা পায়। হাইজিন নিয়েও সচেতনতার অভাব আছে। আর ধর্মীয় গোঁড়ামি তো অনেক আগে থেকেই এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকে অপবিত্রতার নাম দিয়ে সমাজের চোখে কুসংস্কারের বোরখা পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেয়ালটা ভাঙতে হবে তো।
এ প্রসঙ্গে স্টেটওয়াচ রংপুরের নাট্যকর্মী এবং বেগম রোকেয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিফা জাফর অদ্রির সাথে কথা বলে। অদ্রি বলেন, মিন্সট্রেশন আর বাকি জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোর মতই এত স্বাভাবিক যে এটাকে স্বাভাবিক বানানোর লড়াইটা আমাদের এখনও করে যেতে হচ্ছে, এটা বেশ দুঃখজনক। মিন্সট্রেশন লজ্জার হলে, পাবলিকলি টয়লেটে ঢোকাও লজ্জার হবার কথা। একজনের মিন্সট্রেশন চলছে, এক্ষেত্রে এটা যদি লজ্জার হয়ে থাকে, তাহলে কারও বাসা বাড়িতে গেলে কিংবা পাবলিক টয়লেটগুলোতে ঢোকার সময়ও এটা নিয়ে লজ্জা হবার কথা যে মানুষ জেনে যাবে আমার প্রস্রাবের চাপ পেয়েছে। যদি তা না হয়, তাহলে মিন্সট্রেশন আলাদা কোন দিক থেকে?
‘স্যানিটারি প্যাড কিনতে এখনও লজ্জা পায় এমন মেয়ের সংখ্যা কম না। দোকানে অন্য কাস্টমার থাকলে তাদের সামনে প্যাড কিনতে এসেছে বলতে পারে না যারা। কেউ কেউ নিজে কখনও কিনতেই যায় না। অনেকে বাবা কিংবা ভাইকে প্যাড কিনতে বলতে সংকোচবোধ করে। অথচ টয়লেট টিস্যু কিনতে লজ্জা না লাগলে স্যানিটারি প্যাড কিনতে লজ্জা কেনো লাগবে এই প্রশ্নটা তাদের কেউ নিজেকে করছে না। সামাজিক কুসংস্কার আমাদের যেটায় লজ্জা পেতে বলছে, আমরা পাচ্ছি। নিজের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করছি না বলেই আমাদের কেউ কেউ এই ট্যাবু থেকে বের হতে পারছি না। যেটা অপরাধ না, সেটা লজ্জার কেনো হবে?’
‘মিন্সট্রেশন নিয়ে যে সামাজিক কুসংস্কার, এটার সাথে ধর্মীয় কুসংস্কার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা আরেকটাকে হাওয়া দিয়ে আসছে বরাবরই। মিন্সট্রেশনের সময় মেয়েদের মন্দিরে ঢোকা যাবে না, মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না এগুলোর কারণ হিসেবে দর্শানো হয় যে মেয়েদের শরীর এই সময় অপবিত্র থাকে। যেই রক্তটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর, সেটা নিষ্কাশন হবার সময় একটা মেয়ের যখন আরও বেশি শারীরিকভাবে সুস্থ্য হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া চলে, তখন সে অশুদ্ধ হয় কি করে? সামাজিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কার মেয়েদের ডমিনেট করে রাখবার চাহিদা থেকে যে ট্যাবুগুলো তৈরী করেছে, সেগুলো ভাঙা নিয়ে অনীহাই মেয়েদের এখনও লজ্জা নামক মোড়কের ভেতর ঢুকিয়ে রাখছে। মিন্সট্রেশনের জন্য শরীর খারাপ থাকলে সেটা লুকিয়ে অন্য কোনো অসুখের নাম বলা কিংবা মিন্সট্রেশনের সময় রোজা না রাখলেও রোজা আছি বলা, এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে, যা এই ট্যাবু অপ্রয়োজনীয়ভাবে করিয়ে নিচ্ছে।’
চা বাগানের নারী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে ওয়াসিফা জাফর অদ্রি বলেন, ‘চা শ্রমিকরা যেই সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছে, তাদের কাছে মিন্সট্রেশনকে কুসংস্কারের দৃষ্টি থেকে দেখাই স্বাভাবিক। কারণ, কোনো ট্যাবু থেকে বেড়িয়ে আসতে প্রয়োজন যতটা পড়ালিখা কিংবা মুক্তচিন্তার সাথে সংস্পর্শগত আলাপ আলোচনা, তা থেকে তারা বরাবরই বঞ্চিত। গ্রামের স্কুল, কলেজগুলোতে যেভাবে ক্যাম্পিং করে মিন্সট্রেশন নিয়ে আলোচনা করা হয়, তা থেকেও চা শ্রমিকের সন্তানরা বঞ্চিত হচ্ছে কারণ তাদের আয় রোজগারে সন্তানদের পড়ালিখা কুলায়ে উঠতে পারছে না। চা শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা তাদের কুসংস্কারাপন্ন হয়ে থাকবার উপরও তীব্রভাবে প্রভাব রেখে যাচ্ছে।’
মরার উপর খাঁড়ার ঘা ভ্যাট
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো এমন সংবেদনশীল একটি পণ্যের ওপরও বেশ বড় রকমের ভ্যাট আরোপ করা। মেয়েদের অন্যান্য বিলাসী পণ্যের মতো এই স্যানিটারি প্যাডের জন্যও গুনতে হয় ‘পিংক ট্যাক্সের’ অতিরিক্ত মূল্যমান।
নারীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি বস্তুকেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিলাসিতার কাতারে হিসাব করা হচ্ছে। ন্যাপকিন তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
এ ক্ষেত্রে টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট (টিটিআই) ১২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। যেখানে ২৫ শতাংশ দিতে হয় কাস্টমস ডিউটি, ৪৫ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয় কর (এআইটি), ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি এবং ৪ শতাংশ এটিভি। এছাড়া বড় দোকান থেকে কিনতে গেলে আরও ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হয় ক্রেতাকে।
৭ ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরে পুরো পরিবারের বাস, শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে তো ভাবার সুযোগই নেই৷ উপরন্তু দ্রব্যমূল্য পাল্লা দিয়ে বাড়লেও তাদের বেতন সেভাবে বাড়ে না৷ এভাবে নানা বঞ্চনা নিয়ে দুর্দশার জীবন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা৷ এর মধ্যে স্যানিটারি প্যাডের কথা তুললেই কাঁধ আরও ঝুঁকে পড়ে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের। বাড়ছে ঝুঁকি। বাড়ছে রোগ। অল্প বয়সেই ঝরে পড়ছে জীবন। তবু হেলদোল নেই কর্তৃপক্ষের। যেন চা শ্রমিকদের জীবনের একমাত্র কারণ মুনাফা বৃদ্ধি। পুঁজিবাদের এই যুগে শ্রমিকের পিরিয়ডকালীন সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও দৃষ্টিকটু হয়ে পড়েছে।
এসডব্লিউ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ