দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে টানা আটদিন ধরে ধর্মঘট করে আসার পর দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা মজুরি করার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা।
আজ শনিবার বিকালে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন। ফলে আগের মজুরির তুলনায় তাদের দৈনিক মজুরি বেড়েছে ২৫ টাকা।
আন্দোলনকারী সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল সাংবাদিকদের বলেন, ”মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনাকে গ্রহণ করে ওনার সম্মান রক্ষার্থে আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।”
শনিবার বিকাল তিনটায় শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর এই ঘোষণা করা হয়েছে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানিয়েছেন, ”প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ভিত্তিতে চা শ্রমিকরা এই রেট মেনে নিয়েছেন এবং আগামিকাল থেকে তারা কাজে যোগ দেবেন।”
গত ৯ই অগাস্ট থেকে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন চা বাগানগুলোর প্রায় সোয়া লাখ শ্রমিক। সেই সময় প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি করলেও ১৩ই অগাস্ট থেকে তারা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন। ফলে বাংলাদেশের ১৬৭টি চা বাগানে চা পাতা সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রমিকদের দাবি ছিল, ২০২০ সালে যখন শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ নেতাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, সেই সময় মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯ মাস পার হলেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি মালিক পক্ষ।
তবে মালিক পক্ষের বক্তব্য ছিল, দৈনিক মজুরি ছাড়াও শ্রমিকদের রেশন, আবাসনসহ অন্যান্য যেসব সুযোগসুবিধা দেয়া হয়, তার অর্থমূল্য সবমিলিয়ে ৩০০ টাকার বেশি।
যদিও চা-বাগান সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে চা উৎপাদনে বাংলাদেশ নবমস্থানে ওঠে এসেছে। করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা উৎপাদনে সক্রিয় থাকায় ২০২১ সালে দেশে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিকরা দৈনিক ২৩২ রুপি (২৭৭ টাকা) পেয়েও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ শীর্ষ চা-উৎপাদনকারী দেশ চীন ও কেনিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। এ অবস্থায় চা শ্রমিক ইউনিয়ন দাবি করেছিল দেশের চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার।
সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা। চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৩ হাজার ৬০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক আয় ৪৩ হাজার ২০০ টাকা।
বর্তমানে চা-শ্রমিকরা দৈনিক সর্বোচ্চ মজুরি পাচ্ছেন ১২০ টাকা। তাদের মজুরি বাড়ানোর চুক্তি হওয়ার কথা প্রতি ২ বছর পর পর। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আগের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর শ্রীমঙ্গলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই হয়। ওই চুক্তিতে চা-শ্রমিকদের মজুরি ১০২ টাকা থেকে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালে ১ জানুয়ারি থেকে চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কথা। বর্তমানে চুক্তির মেয়াদ ১৯ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। মজুরি বাড়ানোর চুক্তি সই করতে চা-শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও মালিক পক্ষ আলোচনায় আসেনি।
আর এর বিপরীতে চা শ্রমিক ইউনিয়ন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে গত ৯ আগস্ট থেকে ২ ঘণ্টা করে ৪ দিনের কর্মবিরতি শুরু করে। এরপর গত শনিবার থেকে দেশের ১৬৭ চা-বাগানের শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন। বাগানে বাগানে মিছিল, সমাবেশ, পথসভা ও সড়ক অবরোধের কর্মসূচি পালন করেন।
তবে চা-বাগান মালিক পক্ষ শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয় বলে দাবি করছে। তাদের মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের চুক্তি অনুসারে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা থেকে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে মজুরি আরও ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩৪ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক পক্ষ তা মানতে রাজি নয়।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী মনে করেন, শ্রমিকদের দাবি অনুসারে মজুরি বাড়ানো হলে চা-বাগানগুলোকে দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ‘পাতা না তুললে ২ পক্ষেরই ক্ষতি। মৌসুমে একজন শ্রমিক ৫০ কেজি থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত পাতা তুলতে পারেন। সপ্তাহে ২-৩ হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন চা-শ্রমিকের পেছনে মজুরি, রেশন, বাসা, মেডিকেল, বোনাসসহ মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়।’
অথচ শ্রমিকদের অভিযোগ, বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১২০ টাকা মজুরিতে তারা ৫/৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনো মতেই চলতে পারছেন না।
শমশেরনগর চা-বাগানের শ্রমিক মনি গোয়ালা ডেইলি বলেন, ‘স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, ননদসহ ৬ জনের সংসার। মাসে প্রায় ৬৫ থেকে ৭৫ কেজি চাল লাগে। প্রতি কেজি ৭৫ টাকা হলে কমপক্ষে ৩ হাজার ৭৫০ টাকা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘৩ কেজি ডাল ৩৬০ টাকা, আড়াই লিটার সয়াবিন তেল ৫০০ টাকা, আলুসহ শাকসবজি ১ হাজার টাকা, পিয়াজ-রসুন-মশলা-লবণ-চিনি ৭০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল ২৫০ টাকা, পূজা, উৎসব, শ্রাদ্ধ ও ইউনিয়ন চাঁদা ৯০ টাকা, ফান্ড ২৫০ টাকা, মাছ-মাংস-ডিমে ২ হাজার টাকা, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ ৫০০ টাকা ও অন্যান্য ৫০০ টাকা হিসাবে মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। কাপড়-চোপড়ের হিসাব তো বাদই থাকলো। সর্বনিম্ন এই হিসাবেই দৈনিক খরচ আসে প্রায় সাড়ে ৩০০ টাকা।’
দেওছড়া চা-বাগানের মায়া রবিদাস জানান, চা-বাগান থেকে মজুরি পাই মাসে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। সপ্তাহে সাড়ে ৩ কেজি গম দিলেও ওজনে ৩ কেজিই হয়। ১২ বছরের নিচে সন্তান থাকলে গমের পরিমাণ কিছুটা বেশি পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা হিসাবে বাগানের পক্ষ থেকে যেটুকু পাওয়া যায় তা অতি সামান্য। জটিল সমস্যা দেখা দিলে বাগানের বাইরে চিকিৎসা করাতে হয়। যদি ২০ হাজার টাকা বিল আসলে বাগান ম্যানেজার দেন মাত্র ৫ হাজার টাকা।’ ‘সংসারের বাড়তি খরচ যোগাতে বেকার সদস্যরা বাইরে টুকটাক কাজ করেন। এনজিও থেকে ঋণ নেই,’ যোগ করেন মায়া রবিদাস।
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের বলেছি, সবার স্বার্থে আপাতত আন্দোলন বন্ধ করতে হবে। মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ ও আমরা মিলে সভায় সবার কথা তুলে ধরবো।’
‘এই মুহূর্তে মালিকেরা কতো টাকা মজুরি দেবে তা বলার এখতিয়ার আমার নেই। আলোচনায় বসে তারা ঠিক করবেন। দরকার হলে বার বার আলোচনা হবে। আমরা চাই শ্রম-শিল্পবান্ধব পরিবেশ।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল বলেন, ‘সরকার প্রতিনিধি পাঠিয়েছে বলে আমরা এখানে আলোচনায় এসেছি। আমাদের শ্রমিকনেতারা তাদের সমস্যা ও বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন।’
‘মজুরির বিষয়ে মহাপরিচালক সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলন বন্ধ রেখে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। আমরা তা মানিনি। তিনি আমাদের আজ বুধবার ঢাকায় আলোচনায় বসতে বলেছেন। সেখানে মালিকপক্ষও থাকবে।’
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ