সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে অধিকাংশ মানুষেরই দিন শুরু হয়। এই চা তৈরি হয় পাহাড় ও সমতল এলাকায়। পাহাড়ের কোলে ঘন সবুজ চা-বাগিচায় ঘেরা অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে। কিন্তু যে মানুষগুলি ওই বাগানে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন, তাদের জীবন কাটে নিতান্তই অন্ধকারে। তাদের বাঁচার মতো মজুরি নেই, ন্যূনতম পুষ্টিকর খাবার নেই, চিকিৎসা-শিক্ষার যথাযথ সুযোগ নেই। লুটেরা বাগান-মালিক আর পেটোয়া সরকারের যোগসাজশে, ক্ষমতালোভী ট্রেড ইউনিয়নগুলির কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় সহজ-সরল লক্ষ লক্ষ চা-শ্রমিক চরম শোষণ-বঞ্চনার জীবন কাটাচ্ছেন।
এদেশে চা শিল্প বিকাশের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব সময় থেকে চীনদেশে মূলত চায়ের প্রচলন। ৮০০ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে প্রচলন শুরু হলেও এদেশে চায়ের প্রচলন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই। ১৮৩৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের গঠিত কমিটি বিস্তর গবেষণার পর ঘোষণা দেয় যে, আসামের চা চীনা চায়ের চেয়ে অনেক উন্নতমানের।
এ ঘটনা চা শিল্পের জন্য নবদিগন্ত উন্মোচন করে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হয়। কিন্ত সমস্যা হলো বাগান করতে প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এত শ্রমিক আসবে কোথা থেকে? এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে তৈরি হয় মানবসভ্যতার এক নির্মম ইতিহাস।
আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, বাকুড়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে গরীব চাষীকে চা শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। ব্রিটিশরা তাদের সামনে প্রচার করেছিল উন্নত জীবনের নানা গল্প, বলেছিল বাগানের গাছ নাড়া দিলেও নাকি পয়সা পড়বে। শুধুই ছলনা দিয়ে নয়, অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়-ভীতি দেখিয়েও বাধ্য করা হতো তাদের কথা শুনতে।
অসহায় মানুষগুলো ধূর্ত ইংরেজদের কথায় বিশ্বাস করে নিজেদের পরিচিত আজন্ম পরিবেশ ছেড়ে চলে এসেছিল একটু ভালো জীবনের আশায়। দেড় শতাধিক বছর ধরে কী সীমাহীন আত্নত্যাগ আর কি অপূর্ব মমতায় এই শিল্পীরা গড়ে তুলেছে আজকের এই শিল্প তা বাইরে থেকে কল্পনা করা কঠিন। তখনকার গহীন অরণ্য আর পাহাড়ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে চা শিল্পে রূপ দিতে গিয়ে সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল প্রায় দাসোচিত জীবন। তারপরও বুকের নিভৃত কোনে জেগে ছিল একটু ভালো থাকার স্বপ্ন।
ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে দরিদ্র মানুষদের এনে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টিলাভূমিতে চা বাগানের সূচনা করা হয়। সীমাহীন দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে এসব শ্রমিককে সেখানে কাজ করতে হতো। বাজারে প্রচলিত মুদ্রাও তখন তাদের কপালে জুটত না। বাগানে ব্যবহারের জন্য এক ধরনের বিশেষ মুদ্রা পেতেন শ্রমিকরা। এতে তারা বাগানের বাইরে যেতে পারতেন না; বাগানেই তাদের জীবন কাটাতে হতো।
শতাব্দী পেরিয়ে এসে সেই নির্মমতা হয়তো এখন নেই। কিন্তু বঞ্চণার মধ্যেই বাঁচতে হয় বলে অভিযোগ করেন উত্তরাধিকার সূত্রে কাজ পাওয়া চা শ্রমিকরা।
স্বাধীনতার পর এক টাকা দুই আনা মজুরি পেত শ্রমিকরা। পরে সেটা বেড়ে দৈনিক পাঁচ টাকা হয়। এভাবে মজুরি বাড়তে বাড়তে এখন দৈনিক ১২০ টাকা হয়েছে। দুই পূজায় বোনাসও মিলে। কিছু অধিকারও হয়তো পেয়েছে শ্রমিকরা। কিন্তু বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করলে তাতে সংসার চালানেই দায় বলে জানান শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশীয় চা সংসদের আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, পানীয় জলের ব্যবস্থা ও বোনাসসহ ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করবে বাগান মালিক।
মজুরি বাড়ানোর জন্য প্রতি দুই বছর পর পর বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে উভয়ের আলোচনায় ঐক্যমতের পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এই চুক্তি অনুযায়ী, পরবর্তীতে দুই বছর শ্রমিকরা বেতন-ভাতাসহ অনান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন।
চা শ্রমিকদের সঙ্গে সবশেষ দ্বি-বার্ষিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এর পর পরই বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশীয় চা সংসদের কাছে ২০ দফা দাবিনামায় ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি দাবি করেন। এ নিয়ে দফায় দফায় এ পর্যন্ত ১৩টি বৈঠকও হয় দুই পক্ষের মধ্যে। কিন্তু দাবির বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন শ্রমিক নেতারা।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছর পর পর মজুরি বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও মালিকরা চুক্তির আইন ভঙ্গ করছেন। ২০ মাস আগে মজুরি বাড়লে শ্রমিক পরিবারগুলো কিছুটা স্বাচ্ছন্দে সংসার পরিচালনা করতে পারতেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছর পর পর মজুরি বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও মালিকরা চুক্তির আইন ভঙ্গ করছেন। ২০ মাস আগে মজুরি বাড়লে শ্রমিক পরিবারগুলো কিছুটা স্বাচ্ছন্দে সংসার পরিচালনা করতে পারতেন।
দাবি না মানা হলে দেশের সব বাগান একসঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি শ্রমিকরা রাজপথে এসে দাঁড়াবে। বৃহৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্রমিকরা।”
স্বল্পমজুরির পাশাপাশি আরও নানা ক্ষেত্রে চা-শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন। তারা বলেন, দেড় শ বছর একই জমিতে বসবাস করে এখন পর্যন্ত এক খণ্ড ভূমির অধিকার পায়নি এই শ্রমিকরা। শিক্ষায়ও পিছিয়ে রয়েছে এখানকার শিশুরা। বেশির ভাগ বাগানেই বিদ্যালয় নেই। আবার প্রাথমিকের পর শিক্ষার দায়িত্বও নেয় না বাগান কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া শ্রমিকদের জন্য বাগানে স্বাস্থ্যসেবাও অপ্রতুল। বেশির ভাগ বাগানে নামমাত্র একটি চিকিৎসাকেন্দ্র থাকলেও জটিল কোনো রোগ হলে নিজ খরচে বাইরে চিকিৎসা করাতে হয়।
চা গাছ রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা আর চা পাতা সংগ্রহের প্রধান কাজটি নারী শ্রমিকেরা করে আসছে বংশানুক্রমে। নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেক যত্নের সাথে এই কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকদের একটি বড় অংশই কাজ করে চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করার কারখানায়, নিরাপত্তাকর্মী, চা পাতা পরিবহন, ওজনকারী, বাগানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কিংবা শ্রমিকদলের সর্দার হিসেবে। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই বিশাল অংশের কি চা বাগানে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই?
এই প্রশ্নের মূল উত্তর লুকিয়ে আছে চা শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থার সাথে। ১৮৫৪ সাল থেকেই যখন চা শ্রমিকদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয় তখনই তাদের আবাসনের দায়িত্ব নিয়েছিল চা বাগানের মালিক সম্প্রদায়। চা বাগানে কাজ করে এমন যে কারো আবাসন চা বাগান কর্তৃপক্ষই করে দেবে। চা বাগানে কাজ করে না এমন কেউ চা বাগানে বসবাস করতে পারবে না। ফলে চা বাগানের আবাসন বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি পরিবারের অন্তত একজনকে চা শ্রমিক হিসেবে বংশানুক্রমে কাজ করেই যেতে হবে।
স্বল্প মজুরীতে ক্রমবর্ধমান পরিবারের চাহিদা মেটাতে একই পরিবার থেকে অনেকেই চা বাগানে কাজ নিতে শুরু করে। পরিবার আলাদা হয়ে গেলে চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের নতুন আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়।
এই স্বল্প মজুরিতে যেখানে তাদের জীবন ধারণই কঠিন সেখানে তাদের কেউ টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনে মূলধারার সমাজে বসবাস শুরু করবে এই চিন্তাটিও করা কঠিন। ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তর ফারাকের কারণে মূলধারার বাঙালি সমাজের কাছেও নিগ্রহের শিকার এই চা শ্রমিকেরা। চা বাগানের শিশুরাও প্রাক প্রাথমিক আর প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরোতেই ডাক পড়ে চা বাগানে কাজ করার। পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কেউ চা শ্রমিকের পদ থেকে অবসর নিলে সেই পরিবারের কাউকে চা শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যাতে তার পরিবারের আবাসনটি টিকিয়ে রাখা যায়।
এভাবে যুগের পর যুগ ধরে চা বাগানের ভেতরেই জীবন বাঁধা পড়ে আছে তাদের। চা বাগানের শ্রমিকেরা বংশানুক্রমে শত শত বছর ধরে চা বাগানের ভেতরের জমিতে বসবাস করেও পায় না জমির মালিকানা, এক টুকরো জমির জন্য এরা জিম্মি হয়ে আছে মালিকশ্রেণির কাছে। তবে এর মধ্যেও খুব অল্পসংখ্যক লোক চা বাগান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা গ্রহণ করে মূলধারার সমাজে মিশতে শুরু করেছেন।
চা শ্রমিকদের নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েতের মূল কাজ চা শ্রমিকদের সাথে চা বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব নিরসন করা, মালিকপক্ষের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা কিংবা বকেয়া মজুরী আদায়ে সহায়তা করা। এছাড়াও পঞ্চায়েত শ্রমিকদের মধ্যবর্তী পারিবারিক কিংবা সামাজিক দ্বন্দ্ব নিরসন, বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
চা বাগানে শ্রমিক বিদ্রোহও হয়েছে অনেকবার। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহটি হয়েছিল ১৯২১ সালের ২০ মে। বৃহত্তর সিলেট এলাকার চা বাগানের প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ এই নামে আন্দোলনের ডাক দেয়। নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাবার লক্ষ্যে তারা চা বাগান থেকে বেরিয়ে দলে দলে রওনা হয় চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের দিকে। তবে সেখানে চলে পুলিশের গুলি, মারা যায় অনেকেই। বাকিরা জীবনের ভয়ে পালিয়ে আবারো চা বাগানে আশ্রয় নেয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘শ্রমিকরা এখনও অনেকটা ক্রীতদাসের মতোই জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের উন্নয়নে সরকার, মালিকপক্ষ সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদেরও মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের মানসিতায় কিছু গোঁড়ামি থাকায় এখনও অনেক বাগানে শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘ভবিষ্যতে এই শিল্পকে আরও সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ, যেভাবে শ্রমিক বাড়ছে, সেভাবে বাগানের জমি বাড়ছে না। তখন হয়তো দেখা যাবে শ্রমিকদের আবাসনসুবিধা দিতে গিয়ে আবাদের জমি কমে আসবে। এসব সমস্যা সমাধানে চা-বাগান ও চা-শ্রমিকদের নিয়ে একটি বৃহৎ পরিকল্পনার দাবি জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ