এবারের একুশে বইমেলা করোনার কারণে শুরুতেই নানা টালবাহানা সহ্য করে আসছে। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে অনুষ্ঠিত বইমেলা চলাকালীন সময়েও রাষ্ট্রীয় ও মহামারীয় নানা ঝামেলায় ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। বইমেলার গোটা সময়টাতেই প্রকাশকরা বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসলেও লাভের লাভ তেমন কিছুই হয়নি। বিনিয়োগের প্রায় সবটাই গেছে জলে। মেলার শেষ দিনে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, বিপুল অঙ্কের ক্ষতির কবলে পড়েছে তারা। ৯০ কোটি টাকা লগ্নি করে বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ১২ লাখ টাকার।
অন্যান্য বছর প্রকাশকরা মেলাকে কেন্দ্র করে তাদের বিনিয়োগের প্রায় ৩০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ টাকা তুলে আনতে পারেন। বাকি বিনিয়োগ সারা বছর সমগ্র দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রেতাদের মাধ্যমে তুলে আনেন। ২০২০ সালের মেলার পর দেশব্যাপী করোনা বিপর্যয়ের কারণে প্রকাশকরা তাদের ৬৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে আনতে পারেননি। এ বছর তা দাঁড়ালো শতভাগে।
এ বছরের বইমেলায় ক্ষতির পর্যালোচনা ও পরিমাণের চিত্র তুলে ধরেছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।
সোমবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে বইমেলা প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষতির পর্যালোচনা ও পরিমাণ তুলে ধরেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ বছর অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্যাভিলিয়ন ও শিশুচত্বরসহ সর্বমোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৪১৩টি। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট বিনিয়োগ প্রায় ৯০ কোটি টাকা এবং অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগ প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো।
তিনি বলেন, প্রথম ১৪ দিনে ৩০টি প্যাভিলিয়ন বাদে ৩৮৩টি প্রতিষ্ঠানের বিক্রির তথ্য ফরমের চিত্রানুযায়ী গড় বিক্রয় এক কোটি ৫৯ লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৭ টাকা ৪২ পয়সা। শেষ ১১ দিনে গড় বিক্রি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৬১ টাকা ৪০ পয়সা। সুতরাং ২৫ দিনের মোট বিক্রি দুই কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৮ টাকা ৮২ পয়সা। অন্যদিকে বাকি ৩০টি প্যাভিলিয়নে মোট গড় বিক্রি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার ২৩০ টাকা।
সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, দীর্ঘ এক বছরেরও অধিক সময় অর্থাৎ করোনাকালে বাংলাদেশের সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত বাণিজ্যিক খাত বাংলাদেশের প্রকাশনা জগত। আমরা আশা করেছিলাম, অমর একুশে বইমেলা ২০২১ আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকরা বাণিজ্যিকভাবে কিছুটা লাভের মুখ দেখবো, এবারের বইমেলা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা বইমেলা। কিন্তু করোনার জন্য এ বছরের বইমেলায় অর্থনৈতিকভাবে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতির মধ্যে নিপাতিত হয়েছেন প্রকাশকরা।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, এবার মোট ৪১৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (১ ইউনিট স্টল) মেলা উপলক্ষে ন্যূনতম ১০/১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। সব মিলিয়ে এবার প্রকাশকেরা ৯০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছিল। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় এবার ১০০ কোটি টাকারও বেশি বিক্রির আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বিক্রি খুবই হতাশাজনক।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব- প্রকাশকদের ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া। যা সমিতির মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। মেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশকদের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকার বই ক্রয় করা। প্রকাশনা শিল্পের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা৷
মহামারীর মধ্যে অমর একুশে গ্রন্থ মেলার ধারাবাহিকতা রক্ষায় স্বস্তি থাকলেও হিসাবের খেরোখাতা মিলছে না প্রকাশক-বিক্রেতাদের। মেলার সাজসজ্জা ও কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে পুঁজিতেই হাত দিতে হচ্ছে তাদের।
মন খারাপ করা এবারের বইমেলা হিসাবের খাতায় স্টল ও সাজসজ্জা নির্মাণের খরচই যেন মেলাতে পারছে না অনেক প্রকাশনী। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২৫ শতাংশও বিক্রি হয়নি বলে হতাশ প্রকাশকরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরকে গুরুত্ব দিয়ে করোনাভাইরাসের এই দু:সময়ে দেরিতে হলেও মেলা শুরু হওয়ায় কিছুটা হলেও আশাবাদী ছিলেন তারা। তবে কিছু দিন না যেতেই সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হলে ‘লকডাউনের’ বাধ্যবাধকতা তাদের বড় লোকসানে ফেলেছে।
তিউড়ি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাইবম সাধম স্টেটওয়াচকে বলেন, আগাগোড়াই লস এবারের বইমেলা। করোনার কারণে বইমেলা নিয়ে প্রত্যাশা কমে আসলেও যতটা করেছি তার সিকি ভাগও পূরণ হয়নি। উল্টো ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের প্রকাশক ও কবি চৌধুরী ফাহাদ বলেন, এই বছর বইমেলা হবে, হবে না এর দোলাচালে শেষমেষ যে মেলার আয়োজন করা হলো তাতে মনে হয়েছে বইমেলা না হলেই বরং ভালো ছিল। কোনোরকম দায়সারাভাবে একটা যেন-তেন বইমেলা করে ‘তারপরো বইমেলা করেছি’ টাইপ একটস দায়সারা আয়োজন প্রকাশনার ব্যবসার সাথে একরকম মশকারাই বলা যায়!
বইমেলার আয়োজনে বৈষম্যের কথা তুলে ধরে বলেন, এবারের বইমেলাটা যেন একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি তথা এলিট শ্রেণির প্রকাশনীর জন্যই করা হয়েছে! ” তাদের জন্য মেলা করতে গিয়ে তাদের স্পেস দিয়ে কিছু অংশ ছিল, সেখানে তোমাদেরকেও ঢুকিয়ে দিলাম বাপু, যাও খুশী হয়ে যাও এবার” এই বোধের বাইরে কিছুতেই যেতে পারিনি আমরা যারা চেষ্টা করছি৷ এইসব বিভাজন আর্থিক ক্ষতির সাথে মানসিক ক্ষতিরও কারণ।
তিনি বলেন, বোধশক্তির উৎস ও শিকড় হয়ে যাদের থাকার কথা সেখান থেকে এমন দৈন আচরণ আশা করে না, ভবিষ্যতেও আশা করবে না কেউ। আশা করছি ভবিষ্যতে এমন দ্বিচারণ চিন্তা করবেন না কর্তৃপক্ষ। এবং বর্তমান পরিস্থিতি প্রকাশনী সমূহ যে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন এবং বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছেন তা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পন্থা বের করবেন ও প্রকাশনা শিল্প ও প্রকাশনীদেরকে দেউলিয়া হবার দিকে ঠেলে না দিয়ে বাঁচিয়ে তুলবেন, বেঁচে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবেন যথাযথ কর্তৃপক্ষ।
এমন প্রেক্ষাপটে লেখালেখি ও বই প্রকাশের মতো সৃজনশীল কাজকে গতিশীল রাখতে সরকারের আর্থিক প্রণোদনা চান তারা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বই কেনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়াসহ সংকটকালে এসব ‘বিশেষ সুবিধা’ পাবেন বলে প্রত্যাশা তাদের।
কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে নানা অনিশ্চয়তার পর ১৮ মার্চ শুরু হওয়া এবারের বইমেলা নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগে শেষ হয়েছে। মহামারীর গুরুতর পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে ‘কঠোর লকডাউন’ শুরুর আগে সোমবার মেলা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আগেই একাডেমির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ১৪ এপ্রিলের বদলে ১২ এপ্রিল শেষ হবে মেলা।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মেলার সময় কমিয়ে আনার পর থেকেই অনেকটা পরিসর কমতে শুরু করে মেলায়। ক্রেতা-দর্শনাথীদের দেখা না পাওয়ায় গত কয়েক দিনে খরচ বাঁচাতে ১০/১৫টি স্টল আগেই গুটিয়ে নিয়ে চলে যায়। আর স্থান পরিবর্তন ইস্যুতে মনোমালিন্যের জের ধরে লিটল ম্যাগ চত্বরও খালি হয়ে গেছে দিন কয়েক আগেই।
এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার সীমিত পরিসরের এবারের মেলার পর্দা নামায়।
এদিকে প্রতিবছর সমাপনী অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণীর মাধ্যমে মেলা শেষ হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার ছিল না সেই আয়োজন। এমনকি মেলার সেরা বই ও স্টল সজ্জাসহ বিভিন্ন পুরস্কারের বিষয় পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানোর কথা বলেছে বাংলা একাডেমি।
তবে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে।
সেরা তিন প্রতিষ্ঠান হলো যথাক্রমে উড়কি (স্টল নম্বর-৪৩), সংবেদ (স্টল নম্বর-১৮৯, ১৯০) ও কথাপ্রকাশ (প্যাভেলিয়ন-২০)।
এবার মেলায় প্রকাশিত মোট নতুন বইয়ের সংখ্যা ২৬৪০টি। গত বছর মেলায় মোট ৪ হাজার ৯১৯টি বই প্রকাশিত হয়েছিল।
গত বছর বাংলা একাডেমি ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার বই বিক্রি করলে এবার মাত্র ৫০ লাখ টাকার মতো বই বিক্রি করেছে।
মেলায় গতবছর সব প্রকাশনার হিসাব মিলিয়ে মোট ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রির তথ্য জানিয়েছিল বাংলা একাডেমি। তবে এবার তাদের কাছে এই তথ্য নেই।
এসব বিষয়ে বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান অনলাইন ভিত্তিক এক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”বাংলা একাডেমির বই বিক্রির হিসাবটা কাছে আছে। তবে প্রকাশকদের হিসাবটা আমাদের কাছে আসেনি। এবার আমরা ৫০ লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছি।”
বিভিন্ন প্রকাশনার সর্বমোট বই বিক্রির তথ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির মহাসচির ও অনন্যা প্রকাশনীর প্রকাশক মো. মনিরুল হক বলেন,”এবার মোট হিসাবটা পাইনি।মেলায় বই বিক্রি খুবই কম হয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার ১০ শতাংশের বেশি হবে না।”
মেলায় কোনো সমাপনী অনুষ্ঠান না করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার জন্য এবার সমাপনী অনুষ্ঠান করা হয়নি। আর বই বিক্রি কেমন হয়েছে, তা তো সবাই দেখেছেন। আমরা প্রতিবারের মতো এবার প্রকাশকদের কাছ থেকে বিক্রির তথ্য সংগ্রহ করিনি। বাংলা একাডেমির কয়েকজন কর্মকর্তাও করোনা আক্রান্ত।
প্রকাশকদের ক্ষতিপূরণ দাবির বিষয়ে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, এটা প্রকাশকেরা সরকারের কাছে দাবি জানাতেই পারে। তারা যদি বাংলা একাডেমির কাছে কোনো লিখিত প্রস্তাবনা জানায়, আমরা সেটি সরকারের নজরে আনার ব্যবস্থা করব। সরকার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ