পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের পিছন ছাড়ছে না কেলেঙ্কারি। একেরপর এক অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই বন্ধের উপক্রমে দাঁড়িয়েছে। পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকরা এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ করার হেন কোনো উপায় বাদ দেননি যা দ্বারা অর্থ আত্মসাৎ করতে পারেন। পরিচালকদের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠানটি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ইতিমধ্যে আলোচিত। এবার হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর পিপলস লিজিংয়ের ওপর নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, পরিচালকেরা বৈঠক করার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে পিপলস লিজিংয়ের ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্বিক কার্যক্রম নিরীক্ষা করেছে হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং। হুদাভাসির প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, পিপলস লিজিং গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকদের উপহার দেওয়ার জন্য ‘ব্যবসা উন্নয়ন খরচ’ হিসেবে এসব ব্যয় দেখিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ের ভাউচার এবং অন্যান্য ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পর্ষদ বৈঠকে উপস্থিতি বাবদ পরিচালকদের এসব অর্থ দেওয়া হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন বৈঠকের দিন অবৈধভাবে যা উত্তোলন করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের মোট ৯৪টি সভায় অবৈধভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে মোট ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এর মানে, প্রতি সভায় গড়ে খরচ দেখানো হয়েছে৬ লাখ ৯১ হাজার ৩৫৭ টাকা।
হুদাভাসির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরীক্ষাকালীন সর্বোচ্চ ৩৩ লাখ ২৭ হাজার ১২৮ টাকা তুলে নেওয়া হয় ২০১৪ সালে পর্ষদের ২৭২তম বৈঠকে। পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ওই বৈঠকে ১২ জন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। অন্য পরিচালকরা হলেন- পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন সময়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করা মতিউর রহমান, নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন, আরেফিন শামসুল আলামিন, খবির উদ্দিন মিয়া, বিশ্বজিৎ কুমার রায়, নিজামুল আহসান, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, সরদার নিয়ামুল ইসলাম, এএইচ ইকবাল হোসাইন ও দিলালুল হক। এ ছাড়া আমন্ত্রিত হিসেবে পিপলসের নির্বাহী পরিচালক হেলাল উদ্দিন ও মহাব্যবস্থাপক এএনএম তারিক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। পরিচালনা পর্ষদের এক বৈঠকের নামে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৬৪০ টাকা খরচ তুলে নেওয়া হয় ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ২৫১তম বৈঠকে। ওই সময় পিপলসের চেয়ারম্যান ছিলেন মতিউর রহমান। এই বৈঠকেও ১২ জন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। শুধু এএইচ ইকবাল হোসাইনের জায়গায় সেদিন ছিলেন আমিনুল ইসলাম।
হুদাভাসির প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাইলে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জাতীয় দৈনিক সমকালকে বলেন, ‘এমন কোনো প্রতিবেদন বিষয়ে আমার জানা নেই। পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে বিভিন্ন মেমো আসত, আমরা সই করতাম। এভাবে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। টাকা নিলে তো চেকে সই করে নিতাম; প্রমাণ থাকত।’ হুদাভাসির প্রতিবেদনে নগদে অর্থ উত্তোলন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু আমার জানা নেই। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আমাদের নামে কী করেছে, তা আমি জানি না।’
প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকের খরচসহ সার্বিক বিষয় উল্লেখ থাকে। প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর বহিঃনিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষার পর প্রতি বছর তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হয়। আবার পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে উপস্থিত সদস্যদের সম্মানীসহ বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। একটি বৈঠকে উপস্থিতির জন্য একজন পরিচালককে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া যায়। সম্মানী, উপস্থিত সদস্যদের খাবার, নাশতাসহ একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে দেড় থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা খরচ হয় বলে কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলসের অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় সে আবেদন অনুমোদন করলে ১০ জুলাই পিপলসের অবসানের বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই বছরের ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা তোলার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এই টাকার পুরোটাই পিপলস ঋণ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে। এর একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। আর এর পেছনে ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার।
পিকে হালদার নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। এর একটি হল পিপলস লিজিং।
প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। তার মা লীলাবতী হালদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাই কোর্ট।
অভিযোগ রয়েছে, পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকদের এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতে সরাসরি জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক (ইডি) শাহ আলম। বিষয়টি লিখিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এসব বিষয় উল্লেখ করে ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দেন আমানতকারীরা। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত মূল হোতারা অধরাই থেকে গেছেন।
নিয়মিতভাবে চেক ডিজঅনার, মুনাফা প্রদানে বিলম্ব এবং আমানত নগদায়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হতে থাকে পিপলস লিজিং। ফলে পাওনা টাকা পাওয়ার জন্য দলে দলে পিপলস লিজিংয়ের অফিসে ভিড় করতে থাকেন গ্রাহকরা। তখন আমানকারীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের ঝগড়াঝাঁটি ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় পরিচালনা পর্ষদে জায়গা পান অখ্যাত, দুর্নীতিবাজ ও বিভিন্ন বেনামি কোম্পানির কর্ণধাররা। তারা পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে কোম্পানি থেকে অভিজ্ঞ যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি ও মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করেই অন্যায়ভাবে ক্রমাগত ছাঁটাই করতে থাকেন। পাশাপাশি যোগ্যতা, গুণাগুণ, সততা ও অভিজ্ঞতার বিচার না করে উচ্চপদস্থ পদে তাদের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দিতে থাকেন, যারা নতুন পরিচালকদের অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন অনুযায়ী আর্থিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুই স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদে দীর্ঘ চার বছর পাঁচ থেকে ছয় স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন, যা আইন পরিপন্থি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক ভিত ধ্বংস করে দেওয়ার পেছনে একাধিক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা ও দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। এই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদও প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করার পেছনে দায়ী। তারা বলেন, প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকার এখনো কোনো সমাধানে আসতে পারছে না। পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপক অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে পড়ে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। জমানো টাকা ফেরত না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেক আমানতকারী। টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।
এসডব্লিউ/ডিএস/কেএইচ/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ