গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান লেখক ও উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ(৫৩)। লেখালেখির পাশাপাশি দেশের প্রথম কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অন্যতম অংশীদার ছিলেন লেখক মুশতাক আহমেদ। মুশতাকের সেই কুমির খামার গিলে খেয়েছে দেশের আলোচিত আরেক কুমির প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। কুমির খামারটির মালিক এখন পি কে হালদার। কুমির খামারটি পি কে হালদারের হাতে তুলে দেন মুশতাক আহমেদের ব্যবসায়িক অংশীদার মেজবাহুল হক। জানা গেছে, কুমির খামারটির নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণও বের করে নেন পি কে হালদার, যা আর শোধ হচ্ছে না। খামারটির এখন ভঙ্গুর দশা।
২০০২ সালেই মুশতাক স্বপ্ন দেখেছিলেন বন্যপ্রাণী নিয়ে কিছু করার। কুমিরের প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিল তার। সেই স্বপ্ন থেকেই ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে হাতিবেড় গ্রামে ১৩ একর জমিতে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার করেন মুশতাক। তার আগে বাংলাদেশে কুমির চাষের ধারণা কারো ছিল না। তার খামারটির নাম – রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড।
জানা যায়, শুরুতে মালয়েশিয়া থেকে ৭৪টি কুমির আমদানি করে মুশতাকের খামারের যাত্রা হয়। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো দুটি কুমির ৬৯টি ডিম দেয়। তবে মাত্র তিনটি ছানার জন্ম হয়। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে মারা যায় সবক’টি। কিন্তু মুশতাক তাতে হতাশ হননি। পরের বছরই তার খামারে ৬০০টি ডিম থেকে জন্ম নেয় ১৪১টি কুমিরছানা। বর্তমানে খামারটিতে ৩ হাজারের বেশি বিভিন্ন বয়সী কুমির রয়েছে।
জানা যায়, মুশতাক আহমেদের উদ্যোগে ২০০৪ সালে রেপটাইলস ফার্মটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত সমমূলধন সহায়তা তহবিল বা ইইএফ থেকে ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ পায় খামারটি। এ বিনিয়োগের বিপরীতে খামারটির ৪৯ শতাংশ মালিকানা পায় ইইএফ। আর বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের এবং ১৫ শতাংশ মুশতাক আহমেদের। প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ছিল ৫ কোটি টাকা।
রেপটাইলস ফার্মের পর্ষদে মেজবাহুল হক এবং মুশতাক আহমেদ ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালক। তাদের মধ্যে মেজবাহুল হক ছিলেন খামারটির চেয়ারম্যান এবং মুশতাক আহমেদ ছিলেন এমডি। আর ইইএফের ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সাউথইস্ট ব্যাংকের তৎকালীন কর্মকর্তা প্রীতীশ কুমার সরকার ছিলেন মনোনীত প্রতিনিধি। বর্তমানে প্রীতীশ কুমার সরকার এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি। আবার এফএএস ফাইন্যান্সের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে খামারটি।
যে স্বপ্ন থেকে মুশতাক আহমেদ কুমিরের খামার শুরু করেছিলেন, ২০১০ সালে প্রথম রফতানির দিন থেকেই সেই স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে। প্রথমে মালিকানা নিয়ে অংশীদারের সঙ্গে বিভেদ, পরে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে খামারের মালিকানা হারান মুশতাক আহমেদ।
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকার সময় পি কে হালদার মুশতাকের খামারটি কৌশলে দখলে নেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন মুশতাকের ব্যবসায়িক অংশীদার মেজবাহুল হক। মেজবাহ সে সময় একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন এবং খামারের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। মুশতাক ছিলেন এমডি। খামারটি পি কে হালদারের হাতে তুলে দিয়েই মেজবাহুল হক দেশে ছেড়ে চলে যান। এর কিছুদিন পরে পি কে হালদারের চাপে পড়ে মুশতাক আহমেদ তার নামে থাকা খামারটির শেয়ার হস্তান্তরের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। পি কে হালদারের ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডের বাসায় স্বাক্ষর করেন মুশতাক।
খামার হাতছাড়া হওয়ারও সাত বছর পর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন মুশতাক আহমেদ।
২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুকে খামারটির মালিকানা বদল নিয়ে মুশতাক লিখেছিলেন, ‘কুমিরের খামার এখন হায় হায় কোম্পানি। ২০১০ সালের ৩রা জুন ছিল বিশেষ দিন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কুমির রপ্তানি হবে। এর দুই মাস পর চেয়ারম্যান মেজবাহুল হক ঘোষণা দিলেন, কোম্পানি বিক্রি করে দেবেন, আমাকে একটা সাদা কাগজ দিয়ে বললেন সেখানে সাইন করতে। আমি বলে দিলাম সেটা সম্ভব না। শুরু হলো কোর্ট–কাচারি। এরপর প্রশান্ত কুমার হালদার এলেন সামনে। তিনি আমাকে যা বললেন, তাতে বুঝলাম, প্রশান্তের কথায় রাজি না হলে, আমার আম ও ছালা দুইটাই যাবে। একপর্যায়ে আমি আমার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হলাম।’
জানা যায়, নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রেপটাইলস ফার্মের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণও বের করে নেন পি কে হালদার, যা আর শোধ হচ্ছে না।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক খাতের আলোচিত পি কে হালদার পালিয়েছেন বিদেশে। তার বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা একটি মামলা রয়েছে। মামলার এজাহারে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়। পি কের বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারির অংশীদার রাজীব সোমও এখন পরিবার নিয়ে কানাডায় থাকেন। ফলে কুমিরের খামারটিও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। মুশতাক আহমেদের হাতছাড়া হওয়ার পর কুমির চাষের বদলে খামারটির নাম ও জমি ব্যবহার হয়েছে মূলত ঋণ নেওয়ার কাজে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রফতানি না হওয়ায় এরই মধ্যে খামারটিতে কুমিরের সংখ্যা বেড়ে আবাসস্থল ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, ব্যবস্থাপনায় সামান্য ঘাটতি থাকলেও ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ফলে খামারটি এখন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ময়মনসিংহের ভালুকায় রেপটাইল ফার্ম ও আশপাশের বেশকিছু জমির দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। সেসব জমি জব্দ করার নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫২
আপনার মতামত জানানঃ