মহাকাশের অগম্য বিস্তারের দিকে তাকালে চাঁদকে প্রায়ই এক নির্বাক পাথুরে বস্তু বলে মনে হয়—ধূসর, অনুর্বর আর প্রাণহীন। পৃথিবীর আকাশে এটি প্রতিদিনই একইরকম সৌন্দর্য নিয়ে দেখা দেয়, কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ ইতিহাসের স্তরগুলো যেন ক্রমে খুলে যাচ্ছে আধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তির আলোয়। যে চাঁদকে আমরা এখন দেখি, তা নাকি কখনোই এমন ছিল না—এই উপলব্ধি ক্রমেই বিজ্ঞানীদের কৌতূহল বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা আরও রোমাঞ্চকর এক ধারণার সৃষ্টি করেছে: বহু কোটি বছর আগে চাঁদে নাকি সত্যিই তুষারপাতের মতো ঘটনা ঘটত। এই ধারণা বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে, তেমনি প্রশ্নও জাগিয়েছে—কখনো কি চাঁদ ছিল আরও নরম, আরও প্রাণবান এক জ্যোতিষ্ক?
চাঁদের জন্মলগ্নে পৃথিবী ও চাঁদের সম্পর্ক ছিল এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। বৈজ্ঞানিক অনুমান অনুযায়ী, প্রাচীন যুগে চাঁদ ছিল পৃথিবীর কক্ষপথে অনেক কাছে অবস্থান করা একটি উত্তপ্ত ও সদ্য গঠিত উপগ্রহ। পৃথিবীর সঙ্গে নিকটবর্তী অবস্থানের কারণে দুয়ের মধ্যে চৌম্বক ক্ষেত্রের এক যৌথ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র যে আজ আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে, সেই রকমই এক রক্ষাকবচের উল্লেখযোগ্য অংশীদার ছিল একসময়ের চাঁদও। এই সম্মিলিত চৌম্বকীয় সুরক্ষাই চাঁদকে দীর্ঘ সময় ধরে একটি বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল বলে মনে করছেন গবেষকরা।
আজকের চাঁদ যেহেতু সম্পূর্ণ বায়ুমণ্ডলহীন, তাই একসময় সেখানে উল্লেখযোগ্য বায়ুমণ্ডল ছিল—এই ধারণাই নিজে থেকে বিস্ময়কর। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতি জানাচ্ছে, চাঁদের পুরোনো পৃষ্ঠে জমে থাকা খনিজ, রাসায়নিক অবশেষ এবং চৌম্বকীয় তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সেখানে সত্যিই একসময় বায়ুমণ্ডল ছিল। আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, সেই বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব নাকি ছিল আধুনিক মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ, চাঁদ তখন একেবারেই মরুভূমিসদৃশ ছিল না; বরং ছিল নরম, উষ্ণ, পরিবেশগতভাবে সক্রিয় ও পরিবর্তনশীল এক জগৎ।
এই ঘন বায়ুমণ্ডল চাঁদকে সূর্যের ক্ষতিকর সৌরবায়ু থেকে রক্ষা করেছিল। যে সৌরবায়ু এখন চাঁদের পৃষ্ঠে অবিরত আঘাত হানে এবং ধীরে ধীরে চাঁদের উপরের স্তরগুলোকে মুছে দিতে থাকে, সেই শক্তিশালী কণার বৃষ্টি তখন চাঁদের বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যেতে পারত না। ফলে বায়ুমণ্ডলে জমা হতে পারত জলীয় বাষ্প ও কার্বন ডাই–অক্সাইডের মতো পদার্থ। জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি মানেই পানির সম্ভাবনা, আর কার্বন ডাই–অক্সাইডের অর্থ হচ্ছে কোনো এক ধরনের সক্রিয় আবহাওয়াব্যবস্থার সম্ভাবনা। এই দুইয়ের সংমিশ্রণই বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে—তবে কি আসলে সত্যিই চাঁদে তুষারপাত হয়েছিল কোনো এক দীর্ঘ অতীতে?
চাঁদের পৃষ্ঠের বরফের অস্তিত্বের ধারণা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে এসেছেন যে চাঁদের মেরু অঞ্চলের অন্ধকারাচ্ছন্ন গহ্বরগুলোতে জমে থাকতে পারে বরফ, কারণ সূর্যের আলো কখনোই সেখানে পৌঁছায় না। সাম্প্রতিক অভিযান ও উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণে এই ধারণা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। বরফের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে চাঁদের কোথাও না কোথাও একসময় পানির উৎস ছিল। কিন্তু কিভাবে এল এই বরফ? এটা কি শুধু সৌরবায়ুর হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণুর মিলনে সৃষ্টি? নাকি চাঁদের আদি পরিবেশে বরফ তৈরি হয়েছিল আরও বৃহৎ কোনো প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে?
বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, প্রাচীন চাঁদে জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়াত। যখন এই বায়ুমণ্ডল শীতল হতো, তখন বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বরফ কণায় পরিণত হতে পারত। যদি সেই সময় চাঁদের তাপমাত্রা যথেষ্ট নিচে নামত, তাহলে এই বরফ কণা বৃষ্টি বা তুষারপাতের মতো করে পৃষ্ঠে নেমে আসতে পারত। পৃথিবীর আবহাওয়ার মতো হয়তো সেখানে বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়ঝাপটা ছিল না, কিন্তু ধীরে ধীরে ঝরে পড়া বরফ কণার কারণে চাঁদের পৃষ্ঠ ধवल হয়ে উঠত—এমনটা কল্পনা করা এখন আর অবাস্তব নয়।
চাঁদে তুষারপাতের চিন্তাটিই চমকে দেওয়ার মতো। পৃথিবীতে তুষারপাত মানে হলো জলীয় কণার জমাট বাঁধা আকারে পতন। কিন্তু চাঁদে যেহেতু বায়ুমণ্ডল ছিল ভিন্ন প্রকৃতির এবং তাপমাত্রার তারতম্যও ছিল ভিন্ন, সেহেতু সেখানে তুষারপাতের অর্থ দাঁড়ায় হয়তো কার্বন ডাই–অক্সাইডের বরফ, কিংবা জলীয় বরফ—অথবা দুয়ের মিশ্রণ। এটি অনেকটা আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য উপগ্রহ যেমন মঙ্গল, প্লুটো কিংবা ট্রাইটনে দেখা তুষারাপাতের মতো—যেখানে কার্বন ডাই–অক্সাইড বা নাইট্রোজেন বরফ জমাট বেঁধে তুষারের মতো আচরণ করে।
এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে সাম্প্রতিক গবেষণা ও কম্পিউটার সিমুলেশন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে চাঁদ যখন পৃথিবীর খুব কাছে ছিল, তখন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি বড় অংশ চাঁদকে ঢেকে রাখত। এতে চাঁদের পৃষ্ঠে সৌরবায়ুর আঘাত অনেকটাই কমে যেত, ফলে বায়ুমণ্ডল স্থায়ী থাকতে পারত কয়েকশ কোটি বছর পর্যন্ত। এই সময়ে চাঁদের আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে গ্যাস নির্গত হয়ে বায়ুমণ্ডল সমৃদ্ধ করত। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে তৈরি জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে উঠে তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে বরফে পরিণত হওয়াটাই ছিল যৌক্তিক। যে চাঁদ আজ নির্জন ও নির্দয়, সেই চাঁদের বুকে তখন হয়তো নীরবে পড়ে যেত শুভ্র তুষারপাত—যা কোটি কোটি বছর পর আমরা পেয়ে যাচ্ছি বরফের আকারে।
চাঁদের মেরু অঞ্চলে বরফের যে বিশাল মজুদ এখন পাওয়া গেছে, তা এই ধারণারই এক নীরব সাক্ষী বলে মনে করেন গবেষকেরা। পৃষ্ঠের নিচে যে কঠিন বরফের স্তর পাওয়া যায়, তা কি শুধুই সৌরবায়ুর কারণে গঠিত? নাকি সেখানে বহু প্রাচীন তুষারপাতের স্তর জমে রয়েছে—এই রহস্যই এখন গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু।
এই আবিষ্কার শুধু কৌতূহলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রেও তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদি চাঁদের বরফ সত্যিই প্রাচীন তুষারপাতের ফল হয়, তাহলে সেই বরফে হয়তো লুকিয়ে আছে চাঁদের আদি বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক ইতিহাস। ভবিষ্যতের অভিযানে সেই বরফের নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা গেলে জানা যাবে চাঁদের বায়ুমণ্ডলে তখন কোন কোন গ্যাস ছিল, কত চাপ ছিল, তাপমাত্রা কেমন ছিল এবং পানি কীভাবে তৈরি হয়েছিল। এসব তথ্য থেকে বোঝা যেতে পারে পৃথিবী–চাঁদের যৌথ ইতিহাসের সূচনা কেমন হয়েছিল, কীভাবে আমাদের সৌরজগতের পরিবেশ সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে।
এমনকি এই বরফ ভবিষ্যতে মানব বসতি স্থাপনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। চাঁদের বরফ থেকে পানি পাওয়া গেলে তা থেকে তৈরি করা যেতে পারে পানীয় জল, অক্সিজেন কিংবা রকেট জ্বালানি। অর্থাৎ, তুষারপাতের সেই প্রাচীন অতীত মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎকেও প্রভাবিত করতে পারে।
চাঁদের ইতিহাসকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে এই তুষারপাতের ধারণা। একদিকে চাঁদ আজ মরুভূমিসদৃশ শূন্যতা, অন্যদিকে তার জন্মলগ্ন ছিল উত্তপ্ত, গ্যাসসমৃদ্ধ, গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, চাঁদের বুকে এখন দেখা নিস্তব্ধতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক আশ্চর্য পরিবেশগত অতীত, যার বিস্তৃতি শুধুমাত্র মহাজাগতিক ইতিহাসেই নয়, বরং মানবজাতির কল্পনাশক্তিতেও বিরামহীন প্রভাব ফেলবে।
একসময়ের তুষারঢাকা চাঁদকে কল্পনা করলে উঠে আসে নতুন ধরনের সৌন্দর্যের ছবি—যেখানে শীতলতার নীলাভ স্ফটিক কণা ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে ধূসর পাথুরে পৃষ্ঠের ওপর। হয়তো সেই তুষারপাত কোনোদিন ঘটেছিল, হয়তো কোটি বছর আগে সেই শুভ্রতা ঢেকে রেখেছিল চাঁদের উপত্যকা। আজকের চাঁদ সেই স্মৃতি হারালেও বিজ্ঞান থেমে নেই। চাঁদের বরফে বন্দী প্রাচীন কণাগুলো ধীরে ধীরে বলেই দেবে সেই অজানা গল্প—কীভাবে গঠিত হয়েছিল আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, কেমন ছিল তার এককালের আবহাওয়া এবং প্রকৃতির অদৃশ্য নিয়মগুলো কীভাবে তাকে পরিবর্তিত করেছে।
মানুষের কৌতূহলই বিজ্ঞানের শক্তি। চাঁদে তুষারপাতের এই ধারণা হয়তো ভবিষ্যতে আরও গভীর অনুসন্ধানের দিকনির্দেশনা দেবে। হয়তো খুব শিগগিরই আমরা জানতে পারব, চাঁদের শুভ্র অতীত আমাদের আজকের পৃথিবীর ইতিহাসের সঙ্গে কত গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আর সেই আবিষ্কারের পথনির্দেশ করে যাচ্ছে এখনকার গবেষণা—যা বলছে, চাঁদে একসময় সত্যিই বরফ ছিল, শুধু পুঁতে রাখা নয়, আকাশ থেকে ঝরে পড়া বরফ।
আপনার মতামত জানানঃ