
দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও বাস্তবে তা গ্রাস করতে পারেনি। এখন সরকার ‘সামরিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ডিফেন্স ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়—কথা হচ্ছে, দেশে ড্রোন, সাইবার সক্ষমতা ও বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র সরঞ্জাম উৎপাদন করবে বাংলাদেশ; নিজ চাহিদা মেটাবে, বাকি রপ্তানি করবে। ঘোষণা হাসিখুশি মনে হলেও এই উদ্যোগের অর্থনৈতিক-বহুমুখী ও নীতিগত প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এটি শুধু ফ্যাক্টরি নির্মাণ বা বিনিয়োগের বিষয় নয়; এটি দেশের নিরাপত্তা কৌশল, শিল্পনীতি, কর্মসংস্থান এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক জটিল সমীকরণ।
প্রথমত, ধারণাগতভাবে ‘প্রতিরক্ষা শিল্প’ আর সাধারণ শিল্পখাতের সঙ্গে মিশে যায় না। অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকে ঘিরে থাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি-নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা বিধি ও কড়া প্রযুক্তিগত মান। তুরস্ক কিংবা পাকিস্তানের মডেল মতো একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কাঠামো গঠনের প্রস্তাব এসেছে—এটা দরকারও। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে শিল্প-অবকাঠামো, যোগ্য মানবসম্পদ এবং মানসম্পন্ন অংশশিল্প এখনও বিকশিত হচ্ছে, সেখানে ‘ডিফেন্স ইকোনমিক জোন’ স্থাপন মানেই বড় ধরনের সংস্কার। এটা শুধু বিনিয়োগের টাকা নয়; এটি মানসম্পন্ন প্রযুক্তি স্থানান্তর, শ্রমিক প্রশিক্ষণ, গবেষণা-উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতারও প্রশ্ন।
দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগের পরিমান বড়—প্রাথমিক হিসেবে বলা হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক সরকারের জন্য নয়, এটি মূলত পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের তাগিদ ছুড়ে দেয়। বিদেশি প্রযুক্তি ও অংশীদার আসবে কীভাবে? যারা সাহায্য করবে—তুরস্ক, পাকিস্তান ছাড়াও আরও অনেক দেশ—তারা কি প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান হস্তান্তরে সত্যিই আগ্রহী হবে? অনেক উন্নত প্রযুক্তিধারক দেশে অস্ত্রপ্রণালী রপ্তানি কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন। আর সেই প্রযুক্তি দেশের জনসাধারণের কল্যাণে ব্যবহার করা যায় না—এটি জাতীয় নৈতিক ও নীতিগত প্রশ্ন সৃষ্টি করে। বিশাল আর্থিক বিনিয়োগ হলেও যদি প্রযুক্তি-নির্ভরতা বিদেশে থেকেই থাকে, তাহলে আমরা শুধু সমাবেশের স্তূপ বাড়াব, কিন্তু জ্ঞান-শক্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হব।
তৃতীয়ত, সামরিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থাপনামো সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবও বিবেচ্য। প্রথম থেকেই যেখানে হবে জোন—তাই কি সেই এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বিনিবেশ, ভূমি অধিকার, পরিবেশগত মূল্যায়ন এবং স্থানীয় অর্থনীতির ক্ষতি-লাভ সুনির্দিষ্ট ভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে? ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে যদি স্থানীয়দের স্বার্থ বাদ পড়ে, তাতে প্রতিকূল সামাজিক প্রতিবাদ ও আইনি জটিলতা তৈরি হয়। নিরাপত্তা খাতের শিল্প হলেও সেখানকার শ্রমিকরা নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ পাবে কি? পরিবেশগত ঝুঁকি—রসায়ন, ধ্বংসাবশেষ, গোলাবারুদের নিরাপদ নিষ্পত্তি—এই সব আয়োজন এখনই করতে হবে।
চতুর্থত, রপ্তানিমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে আন্তর্জাতিক আইন এবং শুল্ক-নীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো জরুরি। অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, কন্ট্রোল রেজিম (যেমন Wassenaar Arrangement, Arms Trade Treaty—যদিও সব দেশ এতে অংশ নাও নিতে পারে) ও গৃহীত নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। বাংলাদেশ যদি রপ্তানি লক্ষ্য রাখে, তাকে সতর্কভাবে বলতে হবে—কাদের কাছে, কোন অঞ্চলে, এবং কোন ধরণের প্রযুক্তি রপ্তানি করা হবে। সন্ত্রাসবাদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা সহিংস সংঘাত প্রবাহে কোনো সামগ্রী পৌঁছালে সেই দায়াশ্রয় অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।
পঞ্চমত, প্রতিরক্ষা শিল্পকে সফল করতে হলে এক ব্যপক মৌলিক উপাদান দরকার—মানবসম্পদ ও গবেষণা-উন্নয়ন। ডাকসু-আইটি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর সঙ্গে যুদ্ধকালীন টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা ও পাঠ্যক্রমের সংমিশ্রণ জরুরি। শুধু উৎপাদন ইউনিট বসালেই হবে না; স্থানীয় প্রযুক্তিবিদদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, প্রতিরক্ষা-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবার সিকিউরিটি, রোবটিকস ও ড্রোন ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনায়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কি এ খাতে রিলায়েবল কর্মী ও গবেষক গড়ে তুলতে সহায়তা করবে? নইলে দীর্ঘমেয়াদে আমরা কেবল আউটসোর্সিং প্লান্ট হয়ে যাব।
ছয়: অর্থনৈতিক বিবেচনায়, প্রতিরক্ষা শিল্প ‘রিপ্লেসমেন্ট ইফেক্ট’ তৈরির কথা ভাবতে হবে। যে অর্থ সীমিত—১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ—সেটা যদি দেশের সাধারণ শিল্প ও সামাজিক খাতে সরানো হত, তার সামাজিক উপকারিতা কি কম হত? স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এই রিসোর্স অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারত। সুতরাং, সরকারকে স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে হবে কেন প্রতিরক্ষা শিল্পকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং জনকল্যাণের অন্যান্য খাতের সঙ্গে এই বিনিয়োগ কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
একই সাথে কূটনৈতিক মাত্রাও আছে। প্রতিরক্ষা শিল্পে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা মানে নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি। এই সম্পর্কগুলো কখনও কখনও বিদেশনীতি ও বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ অবশ্যই চাইবে যে তার প্রতিরক্ষা শিল্প কোনও নির্দিষ্ট শক্তির সঙ্গে একতরফা নির্ভরশীল না হয়—বহুমুখী অংশীদারিত্ব থাকবে যাতে রাজনৈতিক চাপের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বজায় থাকে।
অবশেষে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। প্রতিরক্ষা খাত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংবেদনশীল—গোপনীয়তা থাকা উচিৎ, তবুও অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ থাকবে না এমনভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। জনবহুল প্রকল্পে ক্রয়-প্রক্রিয়া, চুক্তি আর লগ-বুক সব কিছুতে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে উন্নয়নশীল দেশের গল্পেই পরিণত হবে—বড় ঘোষণার পর খণ্ডিত বাস্তবতা।
সুতরাং, ‘সামরিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’ ধারণাটি বাংলাদেশে সম্ভাবনাময়; তবে এটি সফল করতে হলে কৌশলগত ও নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা হবে কেবল সামরিক উৎপাদন কেন্দ্র নয়, বরং একটি বহুমুখী শিল্প-গঠন যেখানে প্রযুক্তি স্থানান্তর, স্থানীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবেশগত দায়বদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি সম্মান মিলবে। সরকারকে খোলাসা করতে হবে—কোন দেশে অংশীদারিত্ব হবে, কারা বিনিয়োগ করছে, কোন ধরনের প্রযুক্তি আনা হচ্ছে এবং রপ্তানির নীতিমালা কেমন হবে।
যখন দেশ বলবে—আমরা প্রতিরক্ষা শিল্পে আত্মনির্ভর হতে চাই—তখন সেই আত্মনির্ভরতা কেবল অস্ত্রের মাপে বিচার করা উচিত নয়; সেটি বিচার করা উচিত সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতি এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্বের আলোকে। সফল হলে এটি জাতীয় ক্ষমতাকে বাড়াবে, ব্যর্থ হলে তা জনবলের জন্য এক বিপজ্জনক বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এই পথের প্রতিটি মোড়ে জবাবদিহি, নৈতিক বিবেচনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক—নাহলে ‘সামরিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’ কেবল একটি দৃষ্টিনন্দন শ্লোগানে পরিণত হবে, বাস্তবে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে।
	
	
	
	
	
আপনার মতামত জানানঃ