বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এক নতুন ও ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এসেছে—ভুয়া তথ্য ও অপতথ্যের বিস্তার। ডিজিটালি রাইটের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন জগতে রাজনৈতিক বিভাজন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও সামাজিক স্থিতির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ভুয়া রাজনৈতিক তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা তীব্রভাবে বেড়েছে, এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে তা এক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ডিজিটাল প্রচারণার নাম করে রাজনৈতিক দলগুলো, প্রবাসী গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংগঠন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে ব্যস্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির ডিজিটাল প্রচারণা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এসব প্রচারণার মধ্যে সমর্থকদের উৎসাহিত করতে প্রচুর বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাচ্যুত ও নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকা আওয়ামী লীগেরও বড় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে এই অপতথ্যের জগতে। ডিজিটালি রাইট জানিয়েছে, বিদেশি ও প্রবাসী কিছু অংশও এই ডিজিটাল প্রতিযোগিতায় যুক্ত, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিকৃত ছবি, মনগড়া ভিডিও ও প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে নারী প্রার্থী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এআই-নির্ভর কনটেন্ট ব্যবহার করে ভয়ভীতি ও হয়রানি বাড়ানো হচ্ছে। এটি ভোটার দমন ও রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন রূপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে অনলাইনে জনপরিসর অত্যন্ত ভঙ্গুর ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সরকারের এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ভুয়া খবর এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। অথচ এই বিপজ্জনক প্রবণতা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রস্তুতি আশঙ্কাজনকভাবে দুর্বল। দেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকারের সংখ্যা মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জন, যা পরিস্থিতির তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অধিকাংশ গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেকার নেই, সাংবাদিকদেরও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে অনলাইনে ছড়ানো ভুয়া তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা যাচাইয়ের আগে জনমনে প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, নির্বাচন কমিশনেরও ডিজিটাল ভুয়া তথ্য মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নীতি-কাঠামো, দক্ষতা বা সক্ষমতা নেই। নাগরিক সমাজ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদেরও কোনো ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম নেই, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলছে। অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর অনলাইন বিভাগের প্রধান শওকত হোসেন বলেন, প্রচলিত গণমাধ্যমের তথ্য যাচাইয়ের পুরোনো পদ্ধতি এখন আর কার্যকর নয়। ফ্যাক্ট চেকিংকে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রশিক্ষণসমৃদ্ধ পদ্ধতিতে রূপ দিতে হবে।
ইউল্যাবের অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ভুল তথ্য প্রতিরোধে সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সরকারের আলোচনা ও সমঝোতা প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে সরকারের সেই সক্ষমতা কমে গেছে। আগের সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ডিজিটালি রাইটের গবেষণা প্রধান তিতির আব্দুল্লাহ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে দ্রুত কিছু বিধিমালা তৈরি করা হলেও, সেগুলোতে সংজ্ঞার অস্পষ্টতা ও অপব্যবহার রোধের সুরক্ষা অনুপস্থিত।
গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, সাংবাদিক ও ফ্যাক্ট চেকারদের নিয়ে অরাজনৈতিক ফোরাম গঠন করা দরকার। এতে একদিকে প্রশিক্ষণের মান উন্নত হবে, অন্যদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে ফ্যাক্ট চেকারদের সমন্বয়ও জোরদার হবে। ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের সময় ভুয়া তথ্য মোকাবিলাকে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে দেখা উচিত। কারণ, এটি শুধু ভোটের সুষ্ঠুতা নয়, রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অতএব, ডিজিটাল যুগে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ আর শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং প্রযুক্তিগতও। যখন এক ক্লিকেই তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তিকর ছবি ও ভিডিও, তখন সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা মুছে যাচ্ছে দ্রুত। বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো ডিজিটাল সচেতনতা, তথ্যযাচাই কাঠামো এবং আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা। তা না হলে, ২০২৬ সালের নির্বাচন কেবল ভোটের লড়াই নয়—একটি তথ্যযুদ্ধেও পরিণত হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ