
আফগানিস্তান আবারও সেই পরিচিত, বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে এটি আবারও প্রক্সি যুদ্ধের সম্ভাবনায় পড়তে পারে। এই পরিস্থিতি শুধু আফগান জনগণ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ন হচ্ছে, বৈধতা দুর্বল হচ্ছে এবং দেশটি অন্যদের কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যবহার হতে পারে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলায় তালেবান যোদ্ধারা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র মোতায়েন করেছে। একই সময়ে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দিল্লি সফরে ছিলেন। এই দুই ঘটনাই স্পষ্ট করে যে আফগানিস্তানকে এখন আর পাকিস্তানের নিরপেক্ষ প্রতিবেশী হিসেবে দেখা যায় না। কাবুল এখন এমন একটি অবস্থানে রয়েছে, যেখানে কিছু বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হচ্ছে। ইসলামাবাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ধারণা করা হচ্ছে, সীমান্তে হামলা সম্ভবত ভারতের সঙ্গে সমন্বয় বা সহযোগিতায় হয়েছে।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। তখন আফগান ভূখণ্ড বিভিন্ন শক্তির হাতে পরীক্ষা মাটিতে পরিণত হয়েছিল। প্রথমবার সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় এবং দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের অভিযানের সময়। ফলস্বরূপ দেশটি কয়েক দশক ধরে গৃহযুদ্ধ, দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং অস্থিতিশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে। শরণার্থী স্রোত, সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং উগ্র মতাদর্শের বিস্তার এই সময়ে পাকিস্তান, ইরান এবং অন্যান্য অঞ্চলেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। এগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। যদি আফগান সরকারকে বিদেশি শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে দেশের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভেঙে পড়তে পারে। এটি শুধু আফগানদের নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য হুমকি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, বিদেশি শক্তির দ্বারা ব্যবহার করা জাতি দীর্ঘ সময় ধরে অস্থিতিশীলতার চক্রের মধ্যে আটকে থাকে এবং এর ফল ভয়াবহ হয়।
আজও আফগান বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সক্রিয়, এবং ঠিক তখনই ভারতের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ছে। ভারত–তালেবান সমন্বয় এই বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে যে আফগানিস্তানকে এমন কৌশলগত পরিস্থিতিতে টেনে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে দেশটির নিজের জনগণ নাহয়, বিদেশি শক্তির স্বার্থই প্রধান হয়ে ওঠে। অতীতের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, এমন অবস্থায় তালেবানের শাসন দুর্বল হবে এবং নাগরিকদের আস্থা হ্রাস পাবে। এটি এক ধরনের সংঘাতের চক্রের দুয়ার খুলে দেবে, যা কয়েক দশক স্থায়ী হতে পারে।
পাকিস্তানের জন্যও এই পরিস্থিতি বিপজ্জনক। সীমান্তের উসকানি মোকাবিলায় মনোযোগ এবং সম্পদ ব্যয় করতে গিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা দুর্বল হতে পারে। সামরিক বাহিনী চাপের মুখে পড়বে, পূর্ব সীমান্তে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল হবে। যদি পাকিস্তান দুই সীমান্তে চাপে পড়ে, তা সরাসরি ভারতের কৌশলগত সুবিধা বাড়াবে। পাকিস্তানকে তখন তাদের কৌশলগত সীমাবদ্ধতা এবং সামরিক প্রস্তুতিকে সমন্বয় করতে হবে।
আফগানিস্তানে নাগরিকদের স্বাধীনতার অভাবও অস্বাভাবিক নয়। যখন দেশটি অন্যদের কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন সাধারণ জনগণের জীবনে প্রভাব পড়ে। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়, এবং নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। শরণার্থী স্রোত, সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং অর্থনৈতিক সংকট শুধু আফগান সীমান্তে নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
আফগানিস্তানের ইতিহাস থেকে শেখার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, বিদেশি শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত দেশ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আফগান জনগণ সেই সময়ে রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যায়। সেই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য, কাবুলের উচিত কৌশলগত সংযম প্রদর্শন করা এবং নিজ দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দেওয়া। আন্তর্জাতিক দাতা ও বিনিয়োগকারীরা এমন রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দ্বিধা করবে, যারা নিজেদের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে অন্যদের খেলার পুতুল হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান পরিস্থিতি আরও জটিল। পাকিস্তানের সীমান্তে তালেবানের অস্ত্র মোতায়েন, ভারতের সঙ্গে সমন্বয় এবং আফগান সরকারের সীমিত ক্ষমতা একত্রিত হয়ে দেশটিকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে। যদি আফগানিস্তান অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করে, তবে নাগরিকরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। তালেবানের শাসন দুর্বল হবে, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে পড়বে এবং অঞ্চল দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্থিতিশীল থাকবে।
আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের প্রভাব শুধু সীমান্তবর্তী দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। শরণার্থী স্রোত এবং মানবিক সংকট দেশগুলোর উপর চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত, ইরান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করবে। ফলে অঞ্চল দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা এবং অবিশ্বাসের পরিবেশে প্রবেশ করতে পারে।
পাকিস্তানকে অবশ্যই পরিষ্কার কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সীমান্তে কার্যকর নজরদারি এবং প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তারা আফগানিস্তানের সম্ভাব্য উসকানির মোকাবিলা করতে পারবে। তবে পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিশোধ বা প্রতিক্রিয়া সংঘাত বাড়িয়ে দেবে এবং বিদেশি শক্তিদের স্বার্থে সুবিধা করে দেবে। ইসলামাবাদের উচিত কৌশলগত সংযম এবং আন্তর্জাতিক প্রচারণার মাধ্যমে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি সতর্কবার্তা। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, বিদেশি শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত দেশ দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আফগান জনগণ দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি পুনরায় ঘটলে, দক্ষিণ এশিয়ার পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। শরণার্থী স্রোত, সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং অর্থনৈতিক সংকট অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং বৈধতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এগুলো শুধুমাত্র আফগানদের নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার ভিত্তি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক শক্তি এবং স্থানীয় সরকারকে একত্রিত হয়ে এটি রক্ষা করতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে, একই ধরনের ভুল এড়ানো সম্ভব। শিক্ষা না নিলে, ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হবে এবং ভয়াবহ প্রভাব কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।
অতীত এবং বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, আফগানিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। এটি যদি আবারও বিদেশি শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়, তবে তালেবানের শাসন দুর্বল হবে, নাগরিকদের আস্থা হারাবে এবং অঞ্চল দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। পাকিস্তান এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশও সীমান্তে চাপের মুখে পড়বে। তবে আফগান জনগণ যদি নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, আফগানিস্তানকে বিদেশি শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলে শুধু দেশটি নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপদ সৃষ্টি হবে। শরণার্থী স্রোত, সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। আফগান জনগণ, আঞ্চলিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিলে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং একই ধরনের ভুল পুনরায় না করতে হবে। শুধুমাত্র এইভাবে আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব।
আপনার মতামত জানানঃ