সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ৬ থেকে ১৩ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ লেবার পার্টি এই সিদ্ধান্তকে “জনগণবিরোধী” হিসেবে নিন্দা করেছে। পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান অভিযোগ করেছেন, সরকারের অদক্ষতা এবং ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে বাজার এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই বাতাসে দামে হঠাৎ ধাক্কা লেগেছে গরীব ও মধ্যবিত্তের গয়নায় — যারা প্রতিদিন রাঁধছেন তেল— এবং তাদের ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
সয়াবিন তেলের দাম বোতলজাত ক্ষেত্রে প্রতি লিটার ১৮৯ টাকা থেকে ১৯৫ টাকা হয়েছে, অর্থাৎ ৬ টাকা বৃদ্ধি শোনা গেছে। খোলা সয়াবিন তেলের দামও ১৬৯ থেকে ১৭৭ টাকা করা হয়েছে, অর্থাৎ ৮ টাকা বৃদ্ধি। অন্যদিকে, পাম তেলের দাম ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ থেকে ১৬৩ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সয়াবিন তেলের ৫-লিটার বোতলেও ২৫ টাকা করে বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে—নতুন দাম দাঁড়াবে ৯৪৫ টাকা।
কিন্তু অর্থনীতির এমন সংবেদনশীল পণ্য—রান্নার তেল—এর দামের এমন হঠাৎ বৃদ্ধিকে সরকার স্বীকার করছে কি? বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, দামের বৃদ্ধির এই ঘোষণা এসেছে refiners বা ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের পক্ষ থেকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত সরকার এই বৃদ্ধি অনুমোদন দেয়নি। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, “সরকার এখনো কোনো দামের বৃদ্ধি কার্যকর করেনি ও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”
লেবার পার্টির বক্তব্যের মধ্যেই যে প্রধান বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো—জীবিকা সংকটের সময়ে এমন অতিরিক্ত খরচ বোঝা দানায় কার্যত জনগণের ওপর অন্যায়। মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই বাড়িয়ে দিচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের চাপ। মজুরি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় না, আর ব্যয় সীমাহীনভাবে বেড়ে যেতে পারে। এই বাস্তবতা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গীয় মানুষের গৃহস্থালিতে অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাড়াবে।
এ ধরনের সিদ্ধান্তের নিন্দায় শুধু লেবার পার্টি নয়, বাম গণতান্ত্রিক জোটও সরব হয়েছে। তারা বলেছে, এই মূল্যবৃদ্ধি সরকারের বিরল ব্যর্থতা ও সিন্ডিকেটের কারণে, এবং অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের দাবি, গত এপ্রিলেই দাম বাড়ানো হয়েছিল, মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের ব্যবধানে আবার দাম বৃদ্ধি করা জনগণের প্রতি আরও অন্যায় হবে।
তবে কিছু অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী যুক্তি দেখাচ্ছেন—এই দাম বাড়ানো আন্তর্জাতিক বাজারের প্রেক্ষিতে জরুরি। বিশ্ববাজারে তেলের কাঁচামালের দাম বাড়লে আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, যা চূড়ান্ত ভোক্তার দামে প্রতিফলিত হয়। মাঝেমধ্যে এই ধরনের সমন্বয় “আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য” বজায় রাখতে বলা হয়।
তবে এ যুক্তি যে বোঝার যোগ্য, তা সত্বেও পরিস্থিতি অনির্ধারিত ও অসম পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন—কেন এই ঘোষণা আগে কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অনুমোদন সাপেক্ষে এলো না? বিপণন শৃঙ্খলা কোথায়? দামের এই হঠাৎ বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে যন্ত্রণা দেবে—এ কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
চলমান মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার চাপের মধ্যে এই তেল দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বোঝা দেবে— সরকারি নীতির অস্থিরতা, বাজারের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও জনগণের দুরবস্থার প্রতি উদাসীনতা। বিশেষ করে, সরকার প্রয়োজনীয় ব্যয় সীমিত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু অপরদিকে বাজারে এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করেই যে মাস্টারস্ট্রোক হবে—এ ধারণা সংকোচনীয়।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে, প্রতি লিটার ৬ থেকে ১৩ টাকার মতো বৃদ্ধি খাবারে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। রান্নায় যে তেল ব্যবহার করা হয়, তার দাম বাড়লে খাবার খরচও বাড়ে। প্রতিদিনই যে খাবার রান্না করা হয়, তাই এই বৃদ্ধির বোঝা দিনে দিনে বাড়বে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষেরা এই দামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কিন্তু সমস্যাটির মূলে যে ছিল—বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নীতির অভাব—তার দিকে তাকাতে হবে। সরকারের উচিত ছিল প্রথমেই বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা, সম্ভাব্য সংকেত পড়া এবং তেল আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের সঙ্গে ন্যায্য আলোচনা করা। এ ক্ষেত্রে বিকল্প, এমনকি ভর্তুকি বা সমন্বিত মূল্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারত।
দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিতে যদি কার্যকরি ভিত্তি ও স্বচ্ছ যুক্তি না থাকে, তাহলে জনগণের আস্থা জরায়ুতে خواهد ভেঙে পড়বে। বিশেষ করে যখন সরকার ইতিমধ্যেই কঠোর অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির পরিণাম শুধু যে সাময়িক হবে না—এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। অনেকেই বলবেন, “তেলের দাম বাড়ালো, কিন্তু আয় বাড়ল কি?”
এ মুহুর্তে সমাধান জরুরি। প্রথমে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে—এই দাম বৃদ্ধির অনুমোদন তাদের আছে কি না। যদি দরকার হয়, আইসিএমইবি এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইনস্টিটিউটের মতো সংস্থাকে দিয়ে মূল্যসঙ্কলন ও বিশ্লেষণ করতে হবে। বাজারে ঘাটতি বা কোনো অভাব নেই কিনা, তা নিশ্চিত করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দাম বৃদ্ধির বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর বর্তমান পরিস্থিতিতে সংকট বৃদ্ধির কারণ হবে—তাই দরকার ভর্তুকি বা সাবসিডি প্রণোদনা। যেমন—দরিদ্র গোষ্ঠীর জন্য পান্নার বস্তা, সচেতনতা বৃদ্ধির খরচ, খাদ্যে সহায়তা। তেলসহ অন্যান্য সামগ্রিক কন্টেইনার ভর্তুকি বা ন্যায্যকরণ ব্যবস্থাও চিন্তা করতে হবে।
তৃতীয়ত, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও অনিয়ম বন্ধ করতে কঠোর নজরদারি ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। যারা সিন্ডিকেট গঠন করে দামে অতিরিক্ত ভাঁড়ি অংশে বাড়ায় বা চাহিদা–যোগান নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
চতুর্থত, আমদানির খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে সম্ভাব্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—মুদ্রা বিনিময় হার, শুল্ক হার, বন্দরের খরচ—এগুলো ঠিকমতো সমন্বয় করে আমদানির ব্যয় কমিয়ে আনা যেতে পারে।
পঞ্চমত, ভবিষ্যতের বাজার ঝাঁকুনি কাটাতে, দেশীয় তেল উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। উদ্ভাবন, উচ্চ ফলনশীল জাত, কৃষি গবেষণা ও উৎপাদন বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, সয়াবিন ও পাম তেলের দামে ৬ থেকে ১৩ টাকার বৃদ্ধি এমন এক সিদ্ধান্ত যা সাধারণ মানুষের জীবনকাঠামো সরাসরি প্রভাবিত করবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—তা স্পষ্ট নয়—কোন প্রক্রিয়া ও অনুমোদন কাজে লেগেছে কি না। তবে যে ক্ষতিটি ঘটবে, তা ন্যায্যতা ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই উদ্বেগজনক। সরকারের আজকের দায়বদ্ধতা হলো—এই সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করা, প্রভাব কমানো ও বাজারে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনা। সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, জনগণের অধিকার রক্ষা করাই হবে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
আপনার মতামত জানানঃ