আফগানিস্তানে তালিবানের জয়ে পাকিস্তানের গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান নানাভাবেই তালিবানকে সমর্থন, আশ্রয়-প্রশ্রয় সবই দিয়েছে। আফগানিস্তানে শাসকের ভূমিকায় তালিবানের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার আন্তর্জাতিক তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। এসবের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বেঁধেছে।
গত ১৪ এপ্রিল আফগানিস্তান সীমান্তে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অতর্কিত হামলার শিকার হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ওই হামলায় অন্তত সাত পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছেন। শুক্রবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, একসময়ে পাকিস্তান তালিবানের (টিটিপি) শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আফগান সীমান্তের কাছে অতর্কিত হামলার মুখে পড়ে পাকিস্তানের একটি সামরিক বহর। সেনাবাহিনীও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
স্থানীয় সময় গত শনিবার আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় খোশত ও কুনার প্রদেশে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে অন্তত ৪৭ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
গত শনিবার আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় খোশত এবং কুনার প্রদেশে পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। হামলায় নিহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে কমপক্ষে ৩৬ বলে দাবি করা হয়েছিল। মূলত আফগান সীমান্তে গত বৃহস্পতিবার সন্ত্রাসী হামলায় সাত পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার পর এই বিমান হামলার খবর সামনে আসে।
খোশত প্রদেশের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের পরিচালক শাবির আহমাদ ওসমানী গতকাল রোববার বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘খোশত প্রদেশে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমানা বিভাজনকারী রেখা ডুরাল্ড লাইনের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলায় ৪১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। এ ছাড়া হামলায় আরও ২২ জন আহত হয়েছেন।’
খোশতে ৪১ জন নিহত হওয়ার এই তথ্য সেখানকার আরও দুই সরকারি কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন। এদিকে এক আফগান কর্মকর্তা শনিবার বলেন, কুনার প্রদেশে পাকিস্তানের বিমান হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন।
আফগানিস্তানের বৃহত্তম নিউজ চ্যানেল টোলো নিউজে শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখানো হচ্ছে এবং দাবি করা হচ্ছে যে, তারা বিমান হামলায় নিহত হয়েছে। একই চ্যানেলে খোশতের শত শত বাসিন্দা পাকিস্তানের নিন্দা ও পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করছে বলে ফুটেজ প্রকাশ করা হয়েছে।
এই বিমান হামলা নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে গতকাল রোববার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে যেসব সশস্ত্র যোদ্ধা পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে তালিবান কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসীরা দায়মুক্তির সাথে আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কার্যক্রম চালাচ্ছে।’
মূলত আফগান সীমান্তে গত বৃহস্পতিবারের সন্ত্রাসী হামলায় সাত পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার পর এই বিমান হামলার ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে, ৭ সেনা হত্যার প্রতিশোধ নিতেই আফগান ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ করেছে পাকিস্তান।
মূলত আফগান সীমান্তে গত বৃহস্পতিবারের সন্ত্রাসী হামলায় সাত পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার পর এই বিমান হামলার ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে, ৭ সেনা হত্যার প্রতিশোধ নিতেই আফগান ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ করেছে পাকিস্তান।
গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের নর্থ ওয়াজিরিস্তান জেলার ইশাম এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় ৭ পাকিস্তানি সেনা প্রাণ হারান। পাকিস্তান সরকার সেদেশে নিযুক্ত আফগান চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
গত বছর তালিবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা বেড়েছে। ইসলামাবাদ বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আফগান ভূখণ্ড থেকে নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে।
গত বছর তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত উত্তেজনার একটি উৎস হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অভিযোগ, তালিবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে অবস্থান নিয়ে থাকা জঙ্গিরা নতুন উদ্যমে পাকিস্তানে হামলা শুরু করেছে। অপরদিকে কোনো জঙ্গিকে আশ্রয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন আফগানিস্তানের কর্মকর্তারা।
বেশ কয়েক বছর ধরেই সীমান্তের অপর পাশ থেকে ছোড়া পাকিস্তানি গোলায় আফগানিস্তানে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু শনিবারের বিমান হামলায় নিহতের সংখ্যা, সহিংসতা ও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সামরিক শক্তি ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার ইঙ্গিত।
এ হামলার পরপরই এর নিন্দা জানায় তালিবান কর্মকর্তারা। পাকিস্তানের সামরিক বিমান হামলাটি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।
তালিবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ টুইটারে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘খোশত ও কুনারে শরণার্থীদের ওপর পাকিস্তানের হামলার তীব্র নিন্দা জানায় আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাত (আইইএ) । এ ধরনের ইস্যুতে আফগানদের ধৈর্য পরীক্ষা না নেওয়ার এবং একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য আইইএ পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যথায় পরিণতি খারাপ হবে’।
দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সামধান করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এক বিবৃতিতে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শনিবার তালিবান কর্তৃপক্ষ ওই হামলার বিষয়ে তাদের অসন্তোষ জানাতে কাবুলে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং ইসলামাবাদকে দেওয়ার জন্য একটি কূটনৈতিক বার্তা প্রদান করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বিমান হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। বিমান হামলার খবরের বিষয়টি উল্লেখ করা হলে তারা বলেন, সীমান্তের অপর পাশের আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীগুলোর ওপর হামলা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জঙ্গিদের হাত থেকে সীমান্ত এলাকাগুলো সুরক্ষিত করতে তারা তালিবানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্বের সঙ্গে আফগান সরকারের যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটি করছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তার পূর্বসূরি ইমরান খানের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালিবানকে সাহায্য করবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
আফগানিস্তান থেকে জঙ্গিরা পাকিস্তানে হামলা করছে— ইসলামাবাদের এ দাবি তালিবান অস্বীকার করেছে। তবে আল-জাজিরা বলছে, অভিযোগ অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দুই দেশের সীমান্তে ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়া দেওয়ার ঘটনায় ইসলামাবাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে তালিবান নেতৃত্ব।
এদিকে, পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার আজ রোববার কাবুলের তালিবান সরকারকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে গত শনিবারের হামলার বিষয়টি অবশ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি।
ইসলামাবাদের অভিযোগ, তারা ক্রমাগত সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার উত্তর ওয়াজিরিস্তান জেলায় আফগানিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসীরা সাত সেনাকে হত্যা করেছে। এ অঞ্চলে তেহরিক–ই–তালেবান (টিটিপি) জঙ্গিরা এ ধরনের হামলার সঙ্গে জড়িত।
এদিকে অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরান খানের সরে যাওয়ার পর দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রধান শাহবাজ শরিফ। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেননি তিনি।
ইমরানবিরোধী আন্দোলনে শরিকদের অনেকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে চাইছেন না। তাঁদের অনেকে সাংবিধানিক পদে তথা প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, গভর্নর ইত্যাদি পদে যোগ দিতে আগ্রহী হলেও মন্ত্রিসভায় যেতে চাইছেন না। এমনটাই ইঙ্গিত দিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি।
পাকিস্তানের দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন–এর খবরে বলা হয়েছে, পিপিপি মন্ত্রণালয়ের চেয়ে সাংবিধানিক দপ্তরের পদগুলোর দিকে বেশি আগ্রহী। এরই মধ্যে পার্লামেন্টের নতুন স্পিকার হয়েছেন পিপিপির রাজা পারভেজ আশরাফ। এরপর ডেপুটি স্পিকার, সিনেট চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডেন্টের পদের দিকে নজর দলটির। কারণ, ধারণা করা হচ্ছে, আরিফ আলভি শিগগিরই পদত্যাগ করতে পারেন। যদি এমনটা ঘটে, তবে পিপিপি প্রেসিডেন্ট চাইবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ