গাজা উপত্যকা, যা প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে। প্রতিটি দফা সহিংসতা এবং যুদ্ধের মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণ অসংখ্য মানবিক দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাড়িঘর ধ্বংস, জীবনের নিরাপত্তা হারানো, অবরুদ্ধ জীবনযাপন এবং মৌলিক মানবাধিকার হরণ। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রায়শই “শান্তি” এবং “সংলাপ”ের কথা বলে, বাস্তবতা প্রায়শই ভিন্ন। গাজার মানুষের অভিজ্ঞতা দেখায় যে এই সংলাপ প্রক্রিয়াগুলো সাধারণ জনগণের জীবনে কোনো স্থায়ী উন্নতি আনে না।
২০০৭ সালে ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে ছোট, কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, গাজা অবিসংবাদিতভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি কেবল প্রতিরোধের কেন্দ্র নয়, বরং তাদের জাতীয় পরিচয় ও মর্যাদার প্রতীক। এই সময়ে ইসরায়েল গাজার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে, যা মানবিক সংকট তৈরি করলেও ফিলিস্তিনি জনগণ আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তাদের ধৈর্য, সহিষ্ণুতা এবং স্থায়ী প্রতিরোধের মনোভাব প্রদর্শিত হয়েছে প্রতিটি দফা যুদ্ধের সময়।
গাজার ইতিহাসকে যদি ছোটখাটো খণ্ডে ভাগ করা হয়, দেখা যায় যে ২০০৮–০৯ সালের ডিসেম্বর–জানুয়ারির যুদ্ধ, ২০১২ সালের নভেম্বর, ২০১৪ সালের জুলাই–আগস্ট, ২০২১ সালের মে এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া গণহত্যামূলক যুদ্ধ, সবই ফিলিস্তিনিরা যে প্রতিরোধের সক্ষমতা রাখে তা প্রমাণ করেছে। এই সংঘাতগুলিতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, তবে অধিকাংশই সাধারণ নাগরিক। এই ধ্বংসযজ্ঞ, অবরোধ, আন্তর্জাতিক চাপ এবং নিঃসঙ্গতার মধ্যেও গাজা টিকে থাকতে পেরেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর আবার পুনর্নির্মিত হয়েছে, এবং প্রতিরোধের অস্ত্রাগার পুনরায় পূর্ণ হয়েছে।
৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের ‘আল-আকসা ফ্লাড’ অভিযান একটি বড় পরিবর্তন সূচিত করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা স্থিতাবস্থার ভাঙন ঘটায়। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিরোধ ছাড়েনি, বরং শক্তিশালীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে। এই অভিযান ইসরায়েলের জন্য একটি চমকপ্রদ আঘাত হিসেবে প্রমাণিত হয়। এটি দেখায় যে ফিলিস্তিনিরা আর চিরস্থায়ী ভুক্তভোগীর ভূমিকায় থাকতে চায় না।
ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু আরব দেশ একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলেও বাস্তবতার বিচারে এটি অসম্ভব। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছে। প্রতিরোধের সব রূপের বৈধতা রয়েছে এবং এটি ইসরায়েলি উপনিবেশবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কারণে গাজার যুদ্ধবিরতি কোনো শান্তিচুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে না। এটি কেবল সাময়িক বিরতি, কারণ ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
গাজার প্রতিরোধ শুধু সামরিক দিক থেকে নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও শক্তিশালী। ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনযাত্রা, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি সংঘাতের সময়েও টিকে থাকে। স্থানীয় জনগণ ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা পুনর্নির্মাণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তাদের উদ্যোগ, একতা এবং মনোবল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের মূল মন্ত্র হচ্ছে তাদের স্থায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠা। ইতিহাস দেখায় যে, সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক চাপ প্রায়শই নির্দিষ্ট ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের মাধ্যমে সীমিত ফলাফল নিয়ে আসে, সাধারণ জনগণের জন্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, অসলো চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পুরো জনগণকে নয়। ফলস্বরূপ, ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ ছাড়ার পরিবর্তে শহরগুলোতে অভিযান চালিয়েছে, জনগণকে বন্দি করেছে এবং সীমাবদ্ধ করেছে।
গাজার এই শক্তিশালী প্রতিরোধ, যা ফেদায়িন আন্দোলন থেকে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক ও ইসলামি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখিয়েছে যে ইসরায়েলি আধিপত্য স্থাপন করা সহজ নয়। যদিও সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চাপ থাকে, ফিলিস্তিনি জনগণ তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের কৌশল, পরিকল্পনা এবং স্থায়ী মনোবল প্রতিটি আক্রমণের বিরুদ্ধে সফল হয়েছে।
বর্তমান যুদ্ধবিরতি বাস্তবে একটি বিরতি মাত্র। এটি গণহত্যার সাময়িক থামা। ফিলিস্তিনি জনগণ এবং প্রতিরোধ বাহিনী নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে। তারা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো হয়তো এটিকে শান্তি হিসেবে দেখার চেষ্টা করবে, কিন্তু বাস্তবে এটি এমন নয়। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা পুনর্গঠন করতে ব্যস্ত।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ কেবল সামরিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। এটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যের মাধ্যমে শক্তিশালী। তাদের বিদ্যালয়, হাসপাতাল, সম্প্রদায় কেন্দ্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রতিরোধের অংশ। স্থানীয় জনগণ ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা পুনর্নির্মাণে অবদান রাখে। শিশুদের শিক্ষা, নারী ও পুরুষদের জীবনমান এবং সামাজিক সম্পর্ক যুদ্ধের সময়েও সচল থাকে।
ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের একতা। রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো মিলে প্রতিরোধকে কার্যকর করেছে। তারা শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, কৌশলগত এবং সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে ইসরায়েলের চেষ্টা ব্যর্থ করেছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি দেখায় যে ফিলিস্তিনিরা আত্মসমর্পণ করবে না, বরং তারা নিজেদের অধিকার এবং অস্তিত্ব রক্ষায় দৃঢ়।
গাজার এই প্রতিরোধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। এটি দেখায় যে দীর্ঘ সময় ধরে চলা নিপীড়ন, অবরোধ এবং মানবিক দুর্দশা সত্ত্বেও, একটি জনগণ তাদের অধিকার পুনর্গঠন করতে সক্ষম। ফিলিস্তিনি জনগণের স্থায়ী মনোবল, ধৈর্য, এবং সংগ্রামের ইতিহাস ভবিষ্যতের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, গাজার বর্তমান যুদ্ধবিরতি কোনো শান্তিচুক্তি নয়। এটি কেবল একটি সাময়িক বিরতি, যা ফিলিস্তিনি জনগণকে পুনর্গঠন এবং শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ দিয়েছে। তাদের সংগ্রাম, প্রতিরোধ এবং একতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখিয়েছে যে ফিলিস্তিনি জনগণ নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম। ভবিষ্যতে আরও সংঘাত আসবে, কিন্তু গাজার জনগণ তাদের প্রতিরোধের মাধ্যমে এটি মোকাবিলা করবে। এই দৃঢ় মনোবল, একতা এবং প্রতিরোধের ইতিহাস গাজাকে ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী করে তুলেছে।
আপনার মতামত জানানঃ