বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ—তারা নিজেদের আখের গুছিয়েছে এবং নির্বাচনের আগে সেফ এক্সিটের পরিকল্পনা করছে। এই বক্তব্য আসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের মুখ থেকে। তাঁর এই মন্তব্য শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই নয়, পুরো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই বক্তব্যের পর মানুষ প্রশ্ন তুলছে—অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আসলে কতটা স্বচ্ছভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, আর তাঁদের ভূমিকা কতটা নিরপেক্ষ।
নাহিদ ইসলাম একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে এবং গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তিনি আরও বলেন, সময় এলে এদের নামও প্রকাশ করা হবে। তাঁর এই মন্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সততা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। তিনি সরাসরি বলেন, উপদেষ্টাদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করতে চাইছেন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করেন যে, বর্তমান সরকারের ভেতরে দুর্নীতি, স্বার্থসংশ্লিষ্টতা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
তবে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন “নিজেদের আখের গুছিয়েছে” কথাটির মাধ্যমে, সেটি স্পষ্ট করেননি। কিন্তু সবাই জানে, “আখের গুছানো” মানে সাধারণত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের বা আত্মীয়দের স্বার্থে সুবিধা নেওয়া। ফলে অনেকে ধরে নিয়েছেন, নাহিদ ইসলাম পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। যদিও কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে যুক্ত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজনকে পদ থেকে সরিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়াও হয়নি। ফলে প্রশ্ন থেকে গেছে—এই অনিয়মে উপদেষ্টাদের কোনো দায় আছে কি না।
সাম্প্রতিক সময়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া আলোচনায় এসেছেন একটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে এলজিইডি কুমিল্লা অঞ্চলে ২,৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার সবচেয়ে বড় অংশ বরাদ্দ হয়েছে আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ গেছে দেবীদ্বার উপজেলায়, যেখানকার জনপ্রিয় নেতা এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহ। নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে এই প্রকল্প নেওয়া হওয়ায় অনেকে বলছেন, এর উদ্দেশ্য শুধু উন্নয়ন নয়, বরং নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ। কেউ কেউ এটিকে সরাসরি “কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট” বা স্বার্থের সংঘাত বলছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হলো নতুন দুটি বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া। এই লাইসেন্স পেয়েছেন এনসিপির দুই নেতা—আরিফুর রহমান (তুহিন) ও আরিফুর রহমান, যাদের মধ্যে একজন দলটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক এবং অন্যজন জাতীয় নাগরিক কমিটির সাবেক সদস্য। প্রশ্ন উঠেছে, টিভি চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের আছে কি না এবং কেন তাদেরই বেছে নেওয়া হলো। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা না আসায় বিষয়টি আরও বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর এই ঘটনায় মন্তব্য করেছেন যে, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাতমূলক মনোভাব প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। তাঁর ভাষায়, পুরোনো সরকারের মতো ভাগ-বাঁটোয়ারা, নিয়ন্ত্রণ আর স্বজনপ্রীতি এখানেও চলছে।
এই সব ঘটনাই নাহিদ ইসলামের বক্তব্যকে আরও ওজন দিয়েছে। তবে তার বক্তব্যে যে বৈপরীত্য আছে, সেটিও অনেকে লক্ষ্য করেছেন। কারণ, যাদের তিনি অভিযুক্ত করছেন—তাদের অনেকেই তাঁরই সাবেক সহকর্মী, এমনকি তাঁর দলের সদস্য। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি নিজের দলের লোকদের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইছেন?
অন্যদিকে, উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে নাহিদ ইসলামের মন্তব্য আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। তাঁর দাবি, কিছু উপদেষ্টা ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং নির্বাচনের পর নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চান। অর্থাৎ, তাঁরা এখন থেকেই ক্ষমতার পরিবর্তনের পর কোথায় অবস্থান নেবেন, সেটি ভেবে রাখছেন। এই অভিযোগকে রাজনৈতিক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। তবে তিনি বলেছেন, নাহিদ ইসলামের মতো একজন রাজনীতিকের এমন বক্তব্যকে অবহেলা করাও ঠিক হবে না।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের পর তাঁর দলেরই নেতা সারজিস আলম আরও কঠোর ভাষায় বলেন, “উপদেষ্টারা মনে করছেন তাঁরা পালিয়ে বাঁচবেন, কিন্তু পৃথিবীতে কোনো সেফ এক্সিট নেই। একমাত্র সেফ এক্সিট হলো মৃত্যু।” তাঁর এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় তোলে। অনেকে বলেন, এমন বক্তব্য রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রমাণ, যা সরকারের ভেতর-বাইরের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এদিকে, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যদি নাহিদ ইসলাম সত্যিই মনে করেন কেউ সেফ এক্সিটের চেষ্টা করছেন, তাহলে তাঁর উচিত সেই নামগুলো প্রকাশ করা। এতে উপদেষ্টাদের মধ্যে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তা দূর হবে এবং জনগণের কাছেও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে। তিনি মনে করেন, এমন গুরুতর অভিযোগ আড়াল করে রাখা দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, নাহিদ ইসলাম আসলে কি নাম প্রকাশ করবেন? অনেকের মতে, তিনি রাজনৈতিক চাপের কারণে এই অভিযোগ তুলেছেন, আবার কেউ বলছেন, তাঁর হাতে কিছু প্রমাণ থাকতে পারে। তবে এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে আস্থাহীনতা বাড়ছে। যারা একসময় একই লক্ষ্য নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এখন তাদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও অভিযোগ-প্রত্যঅভিযোগের জন্ম হয়েছে।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, এই অস্থিরতা ততই বাড়ছে। একদিকে জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে ক্ষমতার রাজনীতির পুরোনো রীতিতে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা—এই দুইয়ের মাঝে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। নাহিদ ইসলামের অভিযোগ সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন।
অবশেষে বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ মিশে যাওয়ার সংস্কৃতি অনেক পুরোনো। গণতন্ত্রের নামে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রায়ই নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কাজ করেছে—এটাই বাস্তবতা। ফলে “আখের গোছানো” শব্দটি শুধু উপদেষ্টাদের জন্য নয়, পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজকের এই বিতর্ক দেখিয়ে দিয়েছে, দেশের মানুষ এখন শুধু পরিবর্তন নয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও চায়। তারা জানতে চায় কারা আখের গুছিয়েছে, কারা সেফ এক্সিটের চিন্তা করছে। যদি নাহিদ ইসলাম তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাম প্রকাশ করেন, তাহলে হয়তো কিছু সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যদি সেটি রাজনৈতিক কৌশলই হয়, তাহলে এই বিতর্ক কেবল জনমতকে আরও বিভক্ত করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন এখন আগের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার মোহে নয়, দায়িত্বের চেতনায় যদি নেতারা কাজ করেন, তাহলেই সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। নাহিদ ইসলামের বক্তব্য হয়তো বিতর্কিত, কিন্তু এটি দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে—ক্ষমতার আসনে বসে কারা সত্যিই জনগণের জন্য কাজ করছে, আর কারা কেবল নিজেদের আখের গোছাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ