বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের বসবাস ও কর্মসংস্থান নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক একটি খবর আলোচনায় এসেছে—পাবনা সদর উপজেলার বালিয়াহালট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুখ রঞ্জন চক্রবর্তী ভারতীয় নাগরিক হয়েও বাংলাদেশে শিক্ষকতা করছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার দমদম শহরের বাসিন্দা এবং সেখানেই জমি-ফ্ল্যাট কিনেছেন, স্ত্রী-সন্তানও ভারতে থাকেন। অথচ তিনি বাংলাদেশ সরকারের চাকরিবিধি উপেক্ষা করে বহু বছর ধরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। শুধু তাই নয়, শ্বশুরের নামে লিজ নেওয়া সরকারি জমি জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করার চেষ্টার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে উঠেছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন এবং তদন্ত চলছে।
এই ঘটনাটি ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা খাতে এমন অভিযোগ মাঝেমধ্যেই শোনা যায়—বিদেশি নাগরিকরা ভিসার নিয়ম না মেনে অবৈধভাবে চাকরি করছেন, আবার সরকারি সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছেন। এতে একদিকে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় তরুণরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার প্রশিক্ষিত তরুণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চাকরি খুঁজছেন, কিন্তু সীমিত পদে প্রতিযোগিতা এতটাই কঠিন যে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। অথচ ঠিক সেই সময় বিদেশিরা এসে শিক্ষকের পদ দখল করলে স্থানীয়দের ক্ষোভ বাড়া স্বাভাবিক।
চাকরির বাজারে বিদেশিদের উপস্থিতি ইতিমধ্যেই উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কয়েক লাখ বিদেশি বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। পোশাক শিল্পে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও চীনের নাগরিকদের উপস্থিতি বিশেষভাবে বেশি। তারা উচ্চ বেতনে কাজ করছেন, অথচ অনেক সময় একই দক্ষতার বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। এর ফলে একদিকে বিদেশি কর্মীদের আয় হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের বেকারত্বও বাড়ছে।
বিদেশিদের দুর্নীতির আরেকটি বড় দিক হলো কর ফাঁকি। নিয়ম অনুযায়ী বিদেশিদের বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আয়ের টাকা দেশে পাঠানো উচিত, কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই কর পরিশোধ করেন না। হুন্ডি বা অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এতে রাষ্ট্র বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। পাবনার শিক্ষক সুখ রঞ্জন চক্রবর্তীর মতো উদাহরণ দেখাচ্ছে, কেউ কেউ এমনকি সরকারি চাকরি পর্যন্ত দখল করে রেখেছেন—যা শুধু আইনের লঙ্ঘন নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থেরও ক্ষতি।
বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সম্পত্তি দখল বা জালিয়াতির অভিযোগও বাড়ছে। আইনে বিদেশিদের জমি কেনার অনুমতি নেই, কিন্তু তারা আত্মীয় বা সহযোগীর নামে লিজ নিয়ে কিংবা জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমি দখলের চেষ্টা করছেন। পাবনার ঘটনার ক্ষেত্রেও অভিযোগ উঠেছে, শ্বশুরের নামে লিজ নেওয়া জমি নিজের নামে নিতে কৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন অভিযুক্ত শিক্ষক। এতে স্থানীয় পরিবারগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—বিদেশিরা যখন অবৈধভাবে সরকারি পদ দখল করছেন, তখন বাংলাদেশের তরুণদের ভবিষ্যৎ কোথায়? বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখো তরুণ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নেন, অনেকে বছর বছর অপেক্ষায় থাকেন, অথচ সেখানে বিদেশি নাগরিক নিয়োগ পেলে তা সরাসরি বৈষম্যের জন্ম দেয়। স্থানীয় মেধা ও শ্রম অবহেলিত হয়, এবং একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ে।
তবে এটিও স্বীকার করতে হবে যে সব বিদেশি দুর্নীতিতে জড়িত নন। অনেকেই বৈধভাবে কাজ করছেন এবং আইটি, স্বাস্থ্য ও শিল্প খাতে ইতিবাচক অবদান রাখছেন। কিন্তু যারা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে অবৈধভাবে সুবিধা নিচ্ছেন, তারা শুধু অর্থনীতিকেই নয়, সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। তাদের কারণে পুরো বিদেশি সম্প্রদায়কেই সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়।
এই সমস্যার সমাধান জরুরি। প্রথমত, ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি খাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আগে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বিদেশিদের কর ফাঁকি রোধে কড়া নজরদারি চালাতে হবে। চতুর্থত, সম্পত্তি দখল বা সরকারি চাকরিতে বিদেশিদের অনুপ্রবেশের মতো ঘটনার বিরুদ্ধে উদাহরণযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর পঞ্চমত, স্থানীয় তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, পাবনার শিক্ষক সুখ রঞ্জন চক্রবর্তীর ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। এটি দেখাচ্ছে যে, বিদেশিরা চাইলে কীভাবে নিয়ম ভেঙে রাষ্ট্রীয় পদ ও সম্পত্তি পর্যন্ত দখল করতে পারে। যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এ ধরনের অনিয়ম আরও ছড়িয়ে পড়বে। আর এর ফলে একদিকে দেশীয় তরুণরা চাকরি হারাবে, অন্যদিকে অর্থনীতি ও সমাজ দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি নাগরিকরা বৈধভাবে অবদান রাখলে তাদের স্বাগত জানানো উচিত, কিন্তু যারা দুর্নীতি, জালিয়াতি ও অবৈধ সুবিধার আশ্রয় নেবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানানঃ