বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও নির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। ভৌগোলিক নৈকট্য, সাংস্কৃতিক মিল এবং ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে দুই দেশ পরস্পরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও কৌশলগত অংশীদার। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি ও সংযোগ খাতে এই সহযোগিতা গভীরতর হয়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর একের পর এক অশুল্ক বাধা আরোপ করছে। বিশেষ করে পাট ও পাটজাত পণ্য—যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত—এর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ভারতের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এখন এসব পণ্য আর স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, বরং শুধু নাভা শেভা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে হবে। আগে বেনাপোল, বুড়িমারী, হিলি ও সোনামসজিদ সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ পাটজাত পণ্য ভারতে যেত, যা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক, খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক ও কাঠের আসবাবসহ একাধিক খাতেও একই ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ এ ধরনের একতরফা সিদ্ধান্তকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত থেকে সুতার আমদানিতে স্থলপথ নিষিদ্ধ করেছে। যদিও ভারতের অর্থনীতির আকার ও প্রভাব বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড়, তবু এই প্রতিক্রিয়া প্রতীকীভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেখায় যে বাংলাদেশও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কড়া অবস্থান নিতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুই দেশের অর্থনীতি পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ যেমন ভারতের বাজার ও কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি ভারতও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, বাজার ও আঞ্চলিক সংযোগের ওপর নির্ভরশীল।
অর্থনৈতিক দিক থেকে এ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বাংলাদেশের পাটখাতে। একসময় রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল এই খাত। যদিও তৈরি পোশাক শিল্প পরে এর স্থান দখল করে, তবু এখনো পাট রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। এর একটি বড় অংশই আসে ভারতের বাজার থেকে। কেবল ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতের কাছে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ৮৫৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। স্থলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ বহুগুণ বেড়ে যাবে, সময়ও দুই–তিন দিন থেকে ছয়–আট সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যাবে। ফলে ভারতীয় ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজে নিতে পারে এবং বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এই পরিস্থিতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিই ডেকে আনবে না, বরং কূটনৈতিক সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি করবে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা যে ভিত্তি তৈরি করেছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়বে। যখন বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাই যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্কনীতির কারণে অনিশ্চয়তায় ভুগছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরে এ ধরনের টানাপোড়েন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক। ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার কথা বলে, তা এই সিদ্ধান্তে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক কেবল অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জ্বালানি সহযোগিতা, পরিবহন সংযোগ, সীমান্ত হাট, এমনকি ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি ও ২০১৫ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তির মতো উদ্যোগ এই সম্পর্ককে বহুমাত্রিক করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ খাতে যৌথ উদ্যোগ—যেমন রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ সরবরাহ কিংবা বাংলাদেশ–ভারত–নেপাল জলবিদ্যুৎ বাণিজ্য—আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কিন্তু একতরফা বাণিজ্য বাধা এসব ইতিবাচক অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এ অবস্থায় উভয় পক্ষের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। কঠিন বাণিজ্যনীতি হয়তো স্বল্পমেয়াদে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা উভয় দেশের অর্থনীতি ও জনগণের ক্ষতির কারণ হবে। আস্থা, শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক লাভের ভিত্তিতে টেকসই সহযোগিতা ছাড়া কোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাংলাদেশ ও ভারত যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যার সমাধান করে, তবে তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও একটি সফল সহযোগিতার মডেল তৈরি করতে পারবে।
আপনার মতামত জানানঃ