বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত একটি প্রশ্ন হলো—কেন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে আত্ম-অনুশোচনা নেই। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। তারপরও আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোথাও তেমন অনুতাপ বা দায় স্বীকারের প্রবণতা দেখা যায়নি। বরং উল্টোভাবে অনেকেই নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করেছে। এই অনমনীয়তা শুধু রাজনৈতিক নয়, সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।
বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায়, বড় ধরনের সংকট বা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অপরাধ স্বীকার ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নতুন পথ পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান জনগণকে নাৎসি অপরাধের ভয়াবহতা দেখানো হয়েছিল। শুধু ছবি বা ভিডিও নয়, ছিল আলোচনা, প্রশ্নোত্তর ও ‘গাইডেড রিফ্লেকশন’। এতে সাধারণ মানুষ নিজেদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। ফেসবুক বা ইউটিউবের ভিডিও মানুষকে ঘটনাটি মুহূর্তের জন্য কষ্ট দিলেও, তা টেকসই আত্মসমালোচনা গড়ে তুলতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা বরং নিজেদের ‘ইকো চেম্বার’-এর ভেতরেই থেকে গেছেন।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুলগুলোর একটি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত এই স্থানটি শুধু আওয়ামী লীগের নয়, বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাসের প্রতীক। বিরোধিতা করা এক বিষয়, কিন্তু প্রতিপক্ষের আবেগ ও ঐতিহাসিক প্রতীক ভেঙে দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা আরও এককাট্টা হয়েছে এবং বিরোধী পক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যেমন নিজেদের সময়ে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও দমনপীড়নের দায় অস্বীকার করছে, তেমনি জামায়াত-শিবিরও ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার করে আসছে। দুই দলই অপর পক্ষের অপরাধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এই সংস্কৃতি রাজনীতিকে নৈতিকতা ও জবাবদিহি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র সমাজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। অনেকেই ভেবেছিলেন তারা দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়বে। কিন্তু খুব দ্রুত তারা ক্ষমতার অংশ হয়ে পড়ে। এ কারণে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও উগ্রপন্থীদের সমর্থন—এসবের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। নারীর প্রতি সহিংসতা, ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানো ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অবস্থান আরও দৃঢ় করেছে।
রাজনৈতিক ট্যাগিং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও বিভক্ত করেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, যা তাদের সাধারণ সমর্থকদের কোণঠাসা করেছে। অথচ ভারতের আধিপত্যবাদবিরোধিতা আর ভারতবিরোধিতা এক নয়। এই বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা তৈরি করেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরির সুযোগ এসেছিল। আওয়ামী লীগের নীরব অস্বস্তিতে থাকা সমর্থকদের নিরপেক্ষ অবস্থানে আনলে রাজনীতিতে ভারসাম্য আসত। কিন্তু ভুল কৌশল, অপরাধ স্বীকারে অনীহা, প্রতিপক্ষকে ট্যাগিং দেওয়া এবং চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়া—এসব কারণে সেই সুযোগ নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মসমালোচনার সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ যেমন নিজেদের অপরাধ স্বীকার করছে না, তেমনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও নিজেদের ভুলের দায় নিতে চায় না। ফলে রাজনীতি ক্রমেই আরও বিষাক্ত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর যেমন অনেক মানুষ হতাশ হয়েছিলেন, তেমনি ২০২৪ সালের পরও আন্দোলনকারীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। এই হতাশার দায় ভবিষ্যতে ইতিহাস অবশ্যই প্রশ্ন করবে।
আপনার মতামত জানানঃ