ইরানের রেলপথে ঘটছে এক বিপ্লব। বিদ্যুৎচালিত রেললাইনের মাধ্যমে দেশের পূর্ব সীমান্ত সারাখস থেকে পশ্চিমের রাজি পর্যন্ত প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি আধুনিক পরিবহন করিডোর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই রেলপথ চীন ও ইরানের যৌথ বিনিয়োগে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং এটিকে বলা হচ্ছে ‘পূর্ব-পশ্চিম রেলসংযোগের মহাসড়ক’। এটি কেবল একটি পরিবহন প্রকল্প নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ইরান, চীন এবং বৃহত্তর ইউরেশিয়া অঞ্চলের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
ইরানি রেল খাতের মুখপাত্র জাব্বার আলী জাকেরির মতে, প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে এর মাধ্যমে বছরে প্রায় ১.৫ কোটি টন মালবাহী পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। এর ফলে ইরানের পূর্ব-পশ্চিম করিডোরের পরিবহন সক্ষমতা তিন গুণ বাড়বে। পাশাপাশি কিছু অংশে ডাবল ট্র্যাক বসানোর ফলে মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলে গতি আসবে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।
এই চুক্তির ঘোষণা এসেছে চীনের বেইজিং শহরে ইরান ও চীনা রেল শিল্পের প্রতিনিধিদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর। চীনের রেল খাতের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি গুয়ো ঝুঝুয়ে স্পষ্টভাবে বলেন, ইরান হচ্ছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। চীনের এই বৈশ্বিক প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যে অবকাঠামোগত সংযোগ গড়ে তুলে এক নতুন বৈশ্বিক বাণিজ্য রূপরেখা তৈরি করা।
ইরান তার কৌশলগত অবস্থানের কারণে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য একটি আদর্শ সংযোগস্থল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ইরানের ভূ-অবস্থান এমন যে, এটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরেশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য রুট হিসেবে কাজ করতে পারে। চীন এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় এবং তাই ইরানের রেলপথে এই বিপুল বিনিয়োগ।
এই রেল প্রকল্প শুধু ইরানের জন্যই নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি হবে চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত মালবাহী পরিবহনের একটি বিকল্প ও কার্যকর পথ। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ চীন-ইউরোপ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়ে থাকে, যা সময়সাপেক্ষ এবং ভূ-রাজনৈতিক জটিলতায় ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এই নতুন রেলপথ সেই নির্ভরতা কমিয়ে আনবে। এমনকি এটি পাকিস্তানের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও দরজা খুলে দিতে পারে।
ইরান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল রপ্তানিতে অনেকটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে দেশটি চায় অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে। এই রেলপথ প্রকল্প তারই অংশ। এটি ইরানের অর্থনীতিকে তেল ও গ্যাসের বাইরে নিয়ে গিয়ে রপ্তানিমুখী পণ্য পরিবহন, শিল্পায়ন ও আঞ্চলিক বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা এনে দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব আরও বিস্তৃত হবে। এমনকি এটি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে এক চ্যালেঞ্জ হতে পারে। চীন ইতোমধ্যে ইরানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে—জ্বালানি, শিল্প, অবকাঠামো থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি পর্যন্ত। এবার রেল খাতেও চীনের এই সক্রিয়তা বোঝায় যে, বেইজিং ইরানকে কেবল একটি বাণিজ্যিক অংশীদার নয়, বরং কৌশলগত মিত্র হিসেবেও দেখছে।
তবে এই প্রকল্পে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, এটি বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রযুক্তিগত দক্ষতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন। দ্বিতীয়ত, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনা কোম্পানিগুলোর উপরও চাপ বাড়তে পারে। তৃতীয়ত, ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক চাপ এই প্রকল্পে বিলম্ব ঘটাতে পারে।
তবুও আশাব্যঞ্জক দিক হলো—ইরান সরকার রেলপথ সম্প্রসারণকে রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছে। এর মাধ্যমে তারা শুধু চীনের সাথেই নয়, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে পারবে।
এই প্রকল্প সফল হলে তা হবে ‘রেলপথে কূটনীতি’র এক অনন্য উদাহরণ—যেখানে অবকাঠামোই হয়ে উঠবে কৌশলগত সম্পর্ক গঠনের মাধ্যম। এর মাধ্যমে চীন যেমন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগকে শক্তিশালী করবে, তেমনি ইরানও নিজেকে বিশ্ব অর্থনীতির এক নতুন মোড়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
এই রেল বিপ্লব শুধু একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়, বরং এটি বিশ্ব রাজনীতির এক নতুন ধারা সূচিত করার সম্ভাবনা রাখে—যেখানে ইরান, চীন এবং ইউরেশিয়ার মধ্যে গড়ে উঠবে এক অদৃশ্য কিন্তু প্রভাবশালী রেল-জোট, যা আগামী দশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ