ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে একযোগে বাংলাদেশি নাগরিক শনাক্তকরণের যে অভিযান শুরু হয়েছে, তা ঘিরে তৈরি হয়েছে এক গভীর বিতর্ক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট এই ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, কেন হঠাৎ করে দেশজুড়ে বাংলাদেশিদের শনাক্তের এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো এবং কেন সব রাজ্যে জুন মাসকেই বেছে নেওয়া হলো এই অভিযানের জন্য। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও ঋতমকুমার পরিচালিত ডিভিশন বেঞ্চ সরাসরি প্রশ্ন তোলে, এটি পূর্বপরিকল্পিত পদক্ষেপ কি না এবং এই ধরনের অভিযান থেকে কী ধরনের বার্তা সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সাম্প্রতিক নিরাপত্তা ইস্যুর পর সন্দেহভাজনদের গতিবিধির ভিত্তিতে তাদের ডাকা হয়েছে এবং বাংলাভাষার কারণে কাউকে আটক করা হয়নি। যদিও আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বাংলায় কথা বলার জন্য বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে’—এমন অভিযোগ সামনে আসছে এবং সেটি অত্যন্ত গুরুতর। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যার ভিত্তিতে ৪ আগস্ট পরবর্তী শুনানিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এই ঘটনায় সবচেয়ে সরব ভূমিকা পালন করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সরাসরি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং অভিযোগ তুলেছেন যে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের সন্দেহজনকভাবে বাংলাদেশি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, কেবলমাত্র তাদের ভাষার ভিত্তিতে। তিনি বলেছেন, গরিব বাংলাভাষী শ্রমিকদের টার্গেট করে বিজেপি তাদের ওপর জুলুম চালাচ্ছে এবং এটি বিজেপির গরিব-বিরোধী মনোভাবেরই প্রতিফলন।
ওড়িশা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশসহ একাধিক রাজ্যে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া শ্রমিকদের শুধু বাংলায় কথা বলার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। ওড়িশায় ১৭ জন শ্রমিককে সন্দেহে আটক করা হয়, রাজস্থানে অনেককেই আটক করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। গুজরাটে একজন বাঙালি শ্রমিককে তার পরিবারের অভিযোগের পর ছাড়া হয়। দিল্লিতে মিনারুল শেখ নামে একজনকে পর্যন্ত বাংলাদেশে পুশব্যাকের চেষ্টা করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি আসামে উত্তর কুমার ব্রজবাসীর বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে।
এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার সংগঠন ও বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করছেন। ‘মাসুম’ নামক মানবাধিকার সংগঠনের সম্পাদক কিরীটি রায় অভিযোগ করেছেন, অনেক সময় ফরেনার্স আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই মানুষকে ধরপাকড় করা হচ্ছে। তাদের আদালতের রায় ছাড়াই বিএসএফের হাতে তুলে দিয়ে সীমান্ত পার করে দেওয়া হচ্ছে। মূলত যেসব শ্রমিক বাংলাভাষী এবং মুসলমান, তারাই এই টার্গেটিংয়ের শিকার বলে দাবি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিষয়টি আগামী দিনের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এটি বিজেপির বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রধান রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠছে। জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি সাধারণত স্থানীয় জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করে। কিন্তু এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই একই কৌশলে বাংলাভাষীদের ‘অস্মিতা’র প্রশ্ন তুলে বিজেপির বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, বাংলায় কথা বললেই যদি বাংলাদেশি বানিয়ে দেওয়া হয়, তবে এটিকে তিনি মানব না এবং চূড়ান্ত রাজনৈতিক লড়াইয়ের ঘোষণা দেন “খেলা হবে” মন্তব্যের মাধ্যমে।
এই প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশি শনাক্তকরণ ইস্যুটি আর কেবলমাত্র আইন প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি হয়ে উঠেছে এক দোদুল্যমান জাতীয় পরিচয় ও ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার প্রশ্ন। একটি ভাষা কি একটি দেশের সীমারেখা নির্ধারণ করে? শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য কেউ কি বাংলাদেশি হয়ে যায়? এই প্রশ্নগুলো ভারতীয় সংবিধানের বহুত্ববাদী চরিত্র এবং মানবাধিকারের মৌলিক মূল্যবোধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বর্তমান প্রশাসনকে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং যাদের কাছে প্রমাণ নেই, শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, নিরীহ ও দরিদ্র শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এই অভিযানে। এটি রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার এবং ভাষাভিত্তিক বৈষম্যের একটা ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, কোনো নিরীক্ষা ছাড়াই শুধু ভাষার ভিত্তিতে কাউকে সন্দেহ করা হলে, সেটি সহজেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এর ফলে ভারতের মতো একটি বহুভাষী সমাজে গভীর বিভাজন তৈরি হতে পারে এবং ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে জাতিগত উত্তেজনা বাড়তে পারে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি সংবেদনশীল রাজ্যে, যেখানে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বহুদিনের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অভিবাসনের সংযোগ রয়েছে, সেখানে এই ধরনের অভিযান নতুন এক উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে।
শেষ পর্যন্ত এই পুরো বিষয়টি আদালতে নিষ্পত্তি পাবে কি না, কিংবা কেন্দ্র সরকার কী ব্যাখ্যা দেবে, তা সময়ই বলবে। তবে এটি স্পষ্ট যে, বিষয়টি নিছক প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়—এটি এক নতুন ধরনের পরিচয় সংকটের প্রতিফলন, যেখানে একটি ভাষা, একটি ধর্ম, একটি অভিবাসন ইতিহাস, সবকিছু মিলে তৈরি হচ্ছে এক জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ।
আপনার মতামত জানানঃ