হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবতা গণেশ, যার মাথা একটি হাতির। এই চিত্রকল্পটি এতটাই পরিচিত যে হিন্দু সংস্কৃতিতে হাতিকে শুদ্ধতা, সৌভাগ্য ও জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ভারতজুড়ে গণেশ পূজা হয়, বিশেষত মহারাষ্ট্রে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। গণেশের এই হাতির-মাথার উৎস মিথে আবদ্ধ—পিতার রোষে শিরশ্ছেদ এবং পরবর্তীতে হাতির মাথা প্রতিস্থাপনের কাহিনি হিন্দু ধর্মের অন্যতম আকর্ষণীয় পুরাণকথা।
তবে প্রশ্ন হলো, গণেশের মতো দেবতার মাথা হাতির হলেও কেন হিন্দুরা হাতি পূজা না করে গরুকে পূজার মর্যাদা দেয়? এর মধ্যে কি কেবল ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে, নাকি এর সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যাও জড়িয়ে আছে?
প্রথমত, হিন্দু ধর্মে গরু একটি অত্যন্ত পবিত্র প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়। ঋগ্বেদসহ প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গরুর দুধ, দই, ঘি ইত্যাদিকে অমৃত সদৃশ বলা হয়েছে। গাভীকে “গোমাতা” বলে অভিহিত করা হয়, যার দুধ শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্যই উপকারী। কৃষিভিত্তিক সমাজে গরু ছিল একটি অপরিহার্য সম্পদ—চাষের কাজে ষাঁড়, দুধের জন্য গাভী, জ্বালানির জন্য গোবর, এমনকি ঘৃত তৈরিতে গরুর অবদান বিশাল। সেইজন্য গরুকে কেবল প্রাণী নয়, জীবনের সঙ্গে যুক্ত আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক প্রতীক হিসেবে দেখা হতো।
কিন্তু এই ধর্মীয় পবিত্রতা কীভাবে একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হলো?
এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ব্রিটিশ শাসনকাল এবং তার পরবর্তী হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত। ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষের মধ্যে সহাবস্থান ছিল। মুসলিমরা গরুর মাংস খায় এবং কুরবানির ঈদে গরু কুরবানী দেয়—এটি তাদের ধর্মীয় অধিকার। তবে হিন্দু ধর্মে গরু পূজিত হওয়ায় মুসলিমদের এই প্রথা হিন্দু ধর্মানুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। এই সাংঘর্ষিকতাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা শুরু করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীসমূহ।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘গোরক্ষা আন্দোলন’ শুরু হয় উত্তর ভারতে। গরু রক্ষার নামে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। গরুর প্রতি যে শ্রদ্ধা প্রাচীন হিন্দু সমাজে মূলত কৃষিজ সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ ছিল, তা এখন হয়ে ওঠে একটি ধর্মীয় প্রতীক। এর ফলে গরুর দেহে আর কেবল ধর্মীয়তা নয়, রাজনৈতিক পরিচয়ও জুড়ে যায়।
স্বাধীন ভারতের পরেও, বিশেষ করে বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর উত্থানের সাথে সাথে গরুকে ঘিরে রাজনীতি আরও তীব্র রূপ লাভ করে। গরু কুরবানীর অভিযোগে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। গরুর প্রতি আনুগত্য এখন হিন্দুত্ববাদীদের জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের অংশ। গরু রক্ষাকে রাষ্ট্রীয় নীতির রূপ দিতে গিয়ে অনেক রাজ্যে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল খাদ্যাভ্যাসের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং তা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েমের উপায়ও বটে।
অন্যদিকে, হাতি যদিও দেবতা গণেশের প্রতীক, তবু তা হিন্দু রাজনীতির কেন্দ্রে আসেনি। তার কারণ সম্ভবত হাতি পূজা কোনও বৃহৎ রাজনৈতিক বিভাজনের ইস্যু নয়। হাতি সাধারণত রাজশক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক, রাজাদের বাহন, মন্দিরের প্রাঙ্গণে ব্যবহৃত প্রাণী। কিন্তু গণেশপূজা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ইস্যু হয়ে ওঠেনি কখনও। তার কারণ সম্ভবত হাতি কখনোই মুসলিম ধর্মীয় প্রথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়নি।
গরুর ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। মুসলিমদের ধর্মীয় প্রথা ও হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘাত এখানে স্পষ্ট। এই সংঘাতকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করেছে দক্ষিণপন্থী হিন্দু রাজনীতি। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনও মুসলিম যদি গরু পরিবহনের কাজ করে, তাতেও সন্দেহের বশে তাকে মারধর বা হত্যা করা হয়েছে। আবার এইসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে অনেক সময় বলা হয়, “গরু কি তোমার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ?”
এভাবে গরু ধীরে ধীরে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে ওঠে। অথচ প্রাচীন ভারতীয় সমাজে গরু ছিল এক অর্থনৈতিক সম্পদ ও ধর্মীয় প্রতীক, যা সমানভাবে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেই পবিত্র বলে বিবেচিত হয়েছে। এমনকি বৌদ্ধধর্মের প্রসারে সময়ে কিছু জায়গায় গরু কুরবানী কমে গিয়েছিল, কিন্তু তা রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং সহিংসতাবিরোধী মতবাদের প্রভাবে।
তবে মুসলিমদের জন্য গরু কুরবানী ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। এটি তাদের বিশ্বাসের অংশ, কেবল খাদ্যাভ্যাস নয়। অথচ ভারতের মতো দেশ, যেখানে সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেয়, সেখানে গরু কুরবানী বা গরুর মাংস খাওয়াকে অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এর পেছনে আসলে গরুর প্রতি শ্রদ্ধার চেয়ে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষই বেশি সক্রিয় থাকে অনেক ক্ষেত্রে।
এই গরু-পূজাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতিতে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক অস্ত্রায়ন’। যার লক্ষ্য, একদিকে হিন্দু ভোটারদের ধর্মীয় আবেগে জয়ী হওয়া, অন্যদিকে মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা।
এই বিভাজন কেবল ভারতেই নয়, বাংলাদেশের মতো দেশের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ভারতের গরু-সংক্রান্ত ঘটনাগুলির প্রভাব বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্বে বা অনলাইন রাজনৈতিক চর্চায়ও প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ যদিও ঐতিহ্যগতভাবে এতটা গরু-পূজায় আগ্রহী নয়, তবে ভারতের প্রভাবে কখনো কখনো গরুকে ঘিরে ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ায়।
সুতরাং, প্রশ্নটা কেবল ধর্মের নয়, বরং জাতিসত্তা, ক্ষমতার রাজনীতি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠারও। গরু এখানে কেবল পবিত্র প্রাণী নয়, বরং একটি রাজনৈতিক প্রতীক—যার মাধ্যমে হিন্দু পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে মুসলিমদের প্রান্তিক করার চেষ্টা চলে।
হাতির পূজা না করে গরুর পূজাকেই কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর তাই কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক। আর এই জটিলতাই তুলে ধরে উপমহাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি কীভাবে একটি নিরীহ প্রাণীকেও বিভাজনের প্রতীক করে তোলে।
আপনার মতামত জানানঃ