মাত্র ১০ বছর আগে বিদ্যমান ১৯৭৩ সালের আইনের অধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য অভিযুক্ত বাংলাদেশিদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা। অভিযোগ ছিল যে তাঁরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সমর্থনে আল-বদরের মতো আধা সামরিক গোষ্ঠীর অংশ ছিলেন বা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিচারে আটজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন অনেকে। তাঁদের মৃত্যুদণ্ড আপিলের অধীন রয়েছে।
সে সময় হওয়া যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বর্তমানে (২০২৪ সালে) মানুষের মনোভাব কেমন, তা স্পষ্ট না। তবে সে সময় তা জনপ্রিয় ছিল। ২০১৩ সালের এপ্রিলে জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতা মৃত্যুদণ্ডের পরে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিলসন এক মতামত জরিপ চালায়।
এই বিচারকাজ সম্পর্কে জানে এমন ২ হাজার ৫১০ জনের মধ্যে ৮৬ শতাংশ ব্যক্তিগতভাবে এই বিচারকাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সেখানে মত দিয়েছিলেন। এই হার লক্ষণীয়ভাবে বেশি। দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় যাঁরা অপরাধ করেছিলেন, তাঁদের জবাবদিহির পক্ষে দেশে প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল। বিশেষ করে যখন এই ব্যক্তিরাই যুদ্ধোত্তরকালে পুনরুত্থিত জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক নেতৃত্বে এসেছিলেন।
এই বিচারের একটি বড় সমস্যা ছিল। আর তা হলো, এই বিচার জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ছিল গভীরভাবে ত্রুটিযুক্ত। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিচারপ্রক্রিয়ায় এবং আদালতে যা ইচ্ছা তাই করত সরকার। এমনকি আদালতের সামনে থেকে একজন বিবাদী সাক্ষীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপহরণও করা হয়েছিল।
লক্ষণীয়, এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। নিলসনের জরিপে বিচার চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে প্রবল সমর্থন দেখা গেলেও মজার বিষয় হলো একই জরিপে এই বিচারপ্রক্রিয়াকে ‘ন্যায্য’ বলেছে ৩১ শতাংশ আর দ্বিগুণসংখ্যক লোক (৬৩ শতাংশ) একে বলেছেন ‘অন্যায্য’। যাহোক, সেই সময়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ জামায়াতকে দায়ী করতে এত বদ্ধপরিকর ছিল যে তাদের বয়ান বিচারপ্রক্রিয়ার ন্যায্যতা নিয়ে ভ্রুক্ষেপও করেনি।
একই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জাতি বর্তমানে নতুন বিচারের কাজ শুরু করছে। আমাদের উল্লিখিত আগের বিচার এই নতুন বিচারের পটভূমি হিসেবে কাজ করবে। এবার শুনানি হবে আওয়ামী লীগ নেতাদের, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে।
এই তিন সপ্তাহের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের হাতে শত শত বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে। সেই কথা বিবেচনা করলে এই বিচারের আয়োজন ১০ বছর আগের বিচারটির মতোই জনপ্রিয় হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই বিচারও কতটা ন্যায্য হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
উদ্বেগের অন্তত একটি কারণ আছে। ১০ বছর আগের আর আজকের ট্রাইব্যুনাল ঘিরে যে রাজনৈতিক পরিবেশ, তার মধে৵ মিল আছে। ২০১১ সালে মতামত তৈরিতে প্রভাব রাখেন এমন সব ব্যক্তি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক অংশ ও চরিত্রগুলো ধরেই নিয়েছিলেন যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দোষী।
২০২৪ সালে যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের নিয়েও একই পরিবেশ বিদ্যমান। মানুষের শোক এখনো তাজা, আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। মানুষের আবেগ বোধগম্য কারণেই এখন অনেক বেশি উচ্চকিত। প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা তাই আরও বেশি। ঠিক যেমনটি ছিল এক দশক আগে। একটি সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য এ খুব কঠিন পটভূমি।
তবে আগের বিচারের তুলনায় প্রসিকিউটরদের এখন একটি বড় সুবিধা রয়েছে। এবার সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিষয়ে প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। ফলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অন্যায্য পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকার কথা নয়।
১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডের সময় মুঠোফোন ছিল না। প্রাসঙ্গিক প্রত্যক্ষদর্শীর লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় খুব কম। তাই প্রসিকিউটরদের প্রাথমিকভাবে জনগণের কয়েক দশকের পুরোনো স্মৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এর ফলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই প্রসিকিউশনকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কিছু কিছু মিথ্যা প্রমাণ তৈরি করতে হয়েছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। সে সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সমর্থনে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। উপলব্ধ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাবের অর্থ হলো, যেকোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট অপরাধ সরাসরিভাবে ‘যৌক্তিক সন্দেহের বাইরে’ প্রমাণ করা সোজা হবে না। এ কারণেই তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করা নিশ্চিত করতে ট্রাইব্যুনাল আর তৎকালীন সরকারকে প্রক্রিয়াটি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে হয়েছিল।
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের যত পরিমাণ এবং যত ধরনের প্রমাণ রয়েছে, সেদিক থেকে চিন্তা করলে আসন্ন বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধ বিচারের কোনো তুলনাই হয় না। বহু লোক, যাঁরা চোখের সামনে দেখেছেন পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী মানুষের গায়ে পাখির মতো গুলি করছে, তাঁদের স্মৃতিতে এখনো সেসব দৃশ্য জাজ্বল্যমান। এত শক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে রয়েছে ভিডিও প্রমাণ। শত শত হত্যাকাণ্ডের বহু ঘটনাই মুঠোফোনে ধারণ করা আছে। প্রকৃত হত্যাকাণ্ডের, এমনকি আসলে গুলি কে করেছে, অনেক ক্ষেত্রে তারও উল্লেখযোগ্য যাচাইযোগ্য প্রমাণ আছে। যদিও এখনো অনেক কিছু নির্ভর করে কর্তৃপক্ষ কতটা ভালোভাবে এসব প্রমাণ সংগ্রহ করবে, তার ওপর।
যাহোক যে অপরাধের জন্য পুলিশপ্রধান এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার করা হবে, তা হলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আর এই অপরাধ বিভিন্ন টেকনিক্যাল জায়গা থেকে প্রমাণ করা সহজ নয়। বিশেষ করে প্রসিকিউশনকে কোনো চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি প্রমাণের সংযোগ দেখাতে হবে, যা একটি ‘বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্তৃত বা পদ্ধতিগত কোনো আক্রমণের’ অংশ যা নিজে ‘রাষ্ট্রীয় বা সংগঠিত নীতির সম্প্রসারণ’ আর যা সম্পর্কে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অবগত ছিলেন।
এই উপাদানগুলোর বেশ কিছুর, বিশেষ করে ‘সংযুক্তি’র এবং ‘রাষ্ট্র বা সাংগঠনিক নীতির’ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া সহজ হবে না। জ্যেষ্ঠ আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অনেক লিখিত প্রমাণ নষ্ট করে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমন অবস্থায় সম্ভবত কিছু মাঝারি বা উচ্চস্তরের ভেতরের লোকের তাদের রাজনৈতিক ও আইন প্রয়োগকারী নেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রমাণ সরবরাহ করতে হবে।
এখন কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার এই অংশ প্রমাণ করা কঠিন হবে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করার দাবির অনুকূলে রাজনৈতিক পরিবেশও উচ্চকিত হয়ে আছে, তাই গত আইসিটি বিচার যেসব উদ্যোগের কারণে এমন অন্যায্য হয়েছিল, এবারও তেমন কিছু ঘটতে পারে।
ইতিমধ্যে উদ্বেগ ঘটানোর মতো কিছু সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। আগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এবং কোনো রাজনৈতিক সংযুক্তিহীন কাউকে প্রধান প্রসিকিউটর নিয়োগ করার পরিবর্তে, এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি পূর্ববর্তী ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের অনেকের আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন। তিনি ছিলেন জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি রাজনৈতিক দলেরও নেতা। যদিও তাঁর নিয়োগ কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে না।
তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনে অভিজ্ঞ একজন চৌকস আইনজীবী, যিনি এই দাবিও করেন যে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। তবে নিয়োগের বিবেচনায় একে দুর্দান্ত কিছু বলা যাবে না। তদুপরি সরকার এমন তিনজন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে, যাঁদের অভিজ্ঞতা সীমিত। তাঁদের একজনের আবার বিএনপি-সংশ্লিষ্টতা ছিল। এসব ব্যাপারও বিচারক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় খুব একটা আস্থা তৈরি করে না।
সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে দেশের ও সরকারের নিজের স্বার্থেই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে যতটা সম্ভব খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এই নতুন বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে গভীর মনোযোগ থাকবে। এমন মনোযোগ আগে কখনো দেখা যায়নি। এই বিচারে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা (সম্ভবত দেশের সাম্প্রতিকতম প্রধানমন্ত্রীসহ) অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। তাঁদের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক রয়েছে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে। বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো ভুল বা অন্যায় পাওয়া গেলে তারা তা লুফে নিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর সুযোগ সম্ভবত ছাড়বে না।
যাহোক আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এ কী সংশোধন করা হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। সেই সিদ্ধান্ত দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে যে বিচারপ্রক্রিয়া কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে।
তবে এমন কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে যে সরকার রোম সংবিধি থেকে মৌলিক আবশ্যিকতাগুলো তাদের ১৯৭৩-এর আইনের সংশোধনীতে প্রতিফলিত করতে ইচ্ছুক। এই আবশ্যিকতাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে আইনের পরিবর্তনগুলো যথেষ্ট পরিমাণে হবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় আমরা ভারত আর প্রবাসী আওয়ামী লীগপন্থীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিস্ময়কর বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা দেখেছি। এই রাজনৈতিক অংশগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আক্রমণ করতে চাইবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এটা অপরিহার্য যে ট্রাইব্যুনালের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, এমন কোনো বৈধ কারণ যেন নতুন সরকার তাঁদের হাতে তুলে না দেয়।
এমন কিছু যাতে না ঘটে তা সামাল দেওয়া যেতে পারে একটি কাজ করে। আর তা হলো ১৯৭৩ সালের নতুন সংশোধিত আইনটি যেন মূল আন্তর্জাতিক আইনের মানগুলোকে যতটা সম্ভব ঘনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত করে, তা নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকারের এই কাজে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বললে অত্যুক্তি হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ