বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে গত কয়েক বছর ধরেই বেশ সমালোচনা চলছে। এই সমালোচনা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছেন।
বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত মানবাধিকার সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে গত তিন মাসে ৫৬জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও নানা প্রশ্ন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিনিয়তই সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কালাকানুন ব্যবহার করে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘দমন পীড়নের’ সমালোচনা করেছে। যদিও সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
সমালোচনা দিনকে দিন আরো প্রবল হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যখন আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সমালোচনা নতুনভাবে সামনে এসেছে।
প্রথম আলো পত্রিকার সংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেফতার এবং পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার খবরটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপরিচিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এনিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব বিষয়কে ক্ষমতাসীনরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে? তারা কি আদৌ মনে করে যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি তাদের ‘ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত’ করছে?
অনেকে মনে করেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘ইমেজ সংকট’ তৈরি হয়েছে আরো আগে থেকেই।
২০২২ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬২ তম স্থান পেয়েছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় আরও দশ ধাপ পিছিয়েছিল।
সূচকে বাংলাদেশের এই অবস্থার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে’ দায়ী করেছিলেন। ২০২২ সালের ২৪শে মে পিটার হাস ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন।
কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন এসব রিপোর্টে তাদের ‘ইমেজ’ ক্ষুন্ন হয়নি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, সরকার কখনো তার সমালোচনার জন্য কোনো সংবাদমাধ্যম কিংবা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। তার মতে সরকার বিরোধী একটি গোষ্ঠীর তৎপরতায় প্রতিক্রিয়া দেখায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যেগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল নেই বলে মনে করেন তিনি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেসব বিবৃতি বা প্রতিবেদন দিচ্ছে সেগুলোর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগের আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া।
বড়ুয়া মনে করেন, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত তাই সরকারের ইমেজ নষ্টের প্রশ্নই নেই। বরং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী একটি মহল থেকে রিপোর্ট নিয়ে যাচাই বাছাই না করে এবং সব পক্ষের সাথে কথা না বলেই প্রতিক্রিয়া দেখায়।
“এখানে ইমেজ সংকটের বিষয় নেই। তবে আমরা আশা করবো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাচাই করে ও সবার সঙ্গে কথা বরে সত্যতা যাচাই করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে।”
যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন যে আওয়ামী লীগের এবং সরকারের ইমেজ যে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এটা সরকারও বুঝতে পারে কিন্তু সুশাসন ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা না থাকায় তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলেই একের পর এক ঘটনা ঘটছে।
“ফলে কিছু ঘটে গেলে তখন উল্টো গণমাধ্যমকে দোষ দিয়ে সরকার নিজেদের জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। তবে সরকার এও জানে যে এসব বিষয়ে তার বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারেই নেই।”
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকদের ওপর বড় আঘাতের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্থা ও পরবর্তীতে গ্রেফতারের ঘটনা।
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করা এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো আন্তর্জাতিক বিশ্ব। ২০২১ সালের মে মাসে তার গ্রেফতারের আগে তার বেশ কিছু রিপোর্টে দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছিলো যা ক্ষমতাসীন মহলকে বিব্রত করেছিলো। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির তথ্য নিয়ে বেশ কিছু রিপোর্ট করেছিলেন তিনি। রোজিনা ইসলামকে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পুরস্কৃত করেছে।
পরবর্তীতে তিনি মুক্তি পেলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো প্রত্যাহার করেনি সরকার। এ নিয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞ।
যদিও মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন রোজিনা ইসলাম ও সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর ঘটনায় বিস্তারিত না জেনেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
তিনি বলেছেন, সরকার সেক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকে যখন মিডিয়াকে ব্যবহার করে ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছে যে কারণে সেটি হলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এরপর আইনটি কার্যকর করার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে।
গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের মূল বিষয় হলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। চলতি বছরের মার্চ মাসের নয় তারিখে ঢাকায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে বৈঠক করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত আটটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা। সে বৈঠকে রাষ্ট্রদূতরা অন্যান্য ইস্যুর পাশপাশি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়েও কথা বলেন।
২০২১ সালের ৭ই জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিং এ তখনকার মুখপাত্র নেড প্রাইস বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশ সরকার আগ্রাসীভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করেছেI
“আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি তারা যেন সাংবাদিকসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে। যাদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আটক করা হয়েছে, তাদের ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া যেন নিশ্চিত করা হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেফতাররের ঘটনাতেও সরকারের ইমেজ বহির্বিশ্বে দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে ।
রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, এ বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা জানে এবং বোঝে, কিন্তু তারা স্বীকার করতে চায়না।
“সরকার জানে কিন্তু স্বীকার করে না। কারণ সব কিছুর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে ব্যবস্থা নেয়ার দক্ষতা সরকারের নেই। ফলে ঘটনাগুলো ঘটছে। এটা সরকারের না বোঝার কারণ নেই যে তার ইমেজ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা প্রতিনিয়ত সরকারকে এগুলো বলেই আসছে।”
আপনার মতামত জানানঃ