আফগানিস্তানে কমপক্ষে ২২ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের সংকটের মুখে আছে। ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। অথচ আফগান অর্থনীতি পুরোপুরি বিদেশি সহায়তানির্ভর ছিল। আফগান জিডিপির ৪০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা থেকে আসত। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, কোনো দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা থেকে এলে সেটি ‘দাতানির্ভর দেশ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এখানেই বিপদে পড়েছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গত বছরের আগস্টে তাদের সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তালেবান। তারা ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ এর পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তান থেকে নিজেদের মিশন গুঁটিয়ে নেয়। দেশটিতে বন্ধ হয়ে যায় বিদেশি সহায়তার বেশির ভাগও। এ অবস্থায় লাখ লাখ আফগান দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।
গত বছরের আগস্টে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন এ সরকারকে কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আফগানিস্তানে বৈদেশিক সহায়তা প্রবাহও। এ পরিস্থিতিতে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অধিকাংশ দিন ওই সব মানুষের কোনো কাজ জুটছে না।
কতটা ভয়াবহ খাদ্যসংকটে আফগানরা?
আম্মার (ছদ্মনাম) নামে ২০–এর কোঠার এক তরুণ বলেন, তিন মাস আগে নিজের কিডনি বেঁচতে তিনি অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। এ সময় শরীরের পেছনে অস্ত্রোপচারের জায়গা ও সেলাইয়ের চিহ্ন দেখান তিনি।
আম্মার বলেন, ‘আমার বাঁচার কোনো বিকল্প পথ ছিল না। শুনেছিলাম, স্থানীয় একটি হাসপাতালে কিডনি বেচাকেনা হয়। পরে আমিও সেখানে গিয়ে কিডনি বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করি। কয়েক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে ফোন আসে সেখানে যাওয়ার জন্য।’
আম্মার বলেন, ‘তারা (হাসপাতালের লোকজন) কিছু পরীক্ষা করেন। এর পর ইনজেকশন দিয়ে আমাকে অচেতন করেন। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিল না।’
কিডনি বিক্রি করে আম্মার প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার আফগানি (৩ হাজার ১০০ মার্কিন ডলার) পান। এই অর্থের বেশির ভাগটা চলে যায় পরিবারের খাবার জোগাতে করা ঋণ পরিশোধে।
নিরূপায় হয়ে কিডনি বিক্রি করা এই তরুণ তাদের দুর্দশার কথা বলছিলেন, ‘আমরা যদি এক রাত খেতাম, তো পরের রাত না খেয়ে থাকতাম। কিন্তু কিডনি বেচার পর আমার মনে হলো, আমি একজন অর্ধমানব। হতাশ হয়ে পড়লাম। এভাবে চলতে থাকলে, আমার মনে হয়, আমি মরে যাব।’
একটা খোলা ও জীর্ণ বাড়িতে দেখা হয় কমবয়সী এক মায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, সাত মাস আগে তিনি কিডনি বিক্রি করেছেন। তিনিও কিডনি বিক্রি করে পাওয়া অর্থে ঋণ পরিশোধ করেছেন। কিছু ভেড়া কিনতে ওই ঋণ করেছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগে এক বন্যায় ভেড়াগুলো মারা যায়। এতে উপার্জনের পথ হারিয়ে যায়।
এই মা বলছিলেন, তিনি কিডনি বিক্রি করে যে অর্থ পান, তা তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই এখন দুই বছরের সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। যাঁদের কাছ থেকে ঋণ করেছিলেন, তারা প্রতিদিন তাদের হয়রানিতে ফেলছেন। বলছেন, ‘যদি ঋণ শোধ করতে না পার, তবে বাচ্চাটা আমাদের দিয়ে দাও।’
এই নারীর স্বামী বলেন, ‘আমাদের এখন যে অবস্থা, তাতে আমার ভীষণ লজ্জা হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।’
আবদুল গাফফার স্থানীয় কমিউনিটির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা বুঝি, এমন কর্মকাণ্ড ইসলামি আইনের বিরোধী। এভাবে আমরা নিজেদের সন্তানদের জীবনও বিপদের মুখে ফেলছি। কিন্তু অন্য কোনো উপায় নেই।’
আবার হজরতউল্লাহ নামের এক বাবা জানান, তিনি তাঁর কিশোরী মেয়েকে বিক্রি করে প্রাথমিকভাবে যে অর্থ পেয়েছেন, তার বেশির ভাগ খাবার কিনতে খরচ করেছেন। অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে ছোট ছেলেটার জন্য ওষুধ কিনেছেন। বলেন, ‘ছেলেটার দিকে তাকান, সে অপুষ্টিতে ভুগছে।’ পরে বাচ্চাটার শার্ট উঠিয়ে দেখান, পেট ফুলে আছে।
তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে পড়া এ আফগানবাসীদের একজন আবদুল ওয়াহাব। তিনি জানান, ‘আমার বাচ্চারা ক্ষুধায় অনবরত কান্নাকাটি করে। ওরা ঘুমাতে চায় না। আমার ঘরে কোনো খাবার নেই।’ আরও বলেন, ‘তাই, আমি ফার্মেসিতে যাই, ট্যাবলেট কিনি এবং ওদের খাওয়াই; যাতে ওরা একটু ঘুমায়।’
আবদুল ওয়াহাব আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাতের কাছে থাকেন। তিনি ঘিঞ্জিময় এমন এক বসতিতে থাকেন; যেখানে হাজার হাজার মাটির খুপরি ঘর। দশকের পর দশক ধরে এগুলো গড়ে উঠেছে। এখানে যাঁরা আছেন, তারা যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষ।
গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ওই বসতিতে গেলে বেশ কয়েকজন তাদের ঘিরে জড়ো হন। তাদের মধ্যে কতজন সন্তানদের শান্ত রাখতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ান—জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘আমাদের অনেকে, আমরা সবাই।’
এ সময় গুলাম হজরত নামের একজন তার পরনে থাকা আলখেল্লার পকেটে ঢুকিয়ে এক পাতা ট্যাবলেট বের করে আনেন। সাধারণত উদ্বেগ–দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এ ওষুধ পথ্য হিসেবে সেবন করার অনুমতি দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
গুলাম হজরতের ছয় সন্তান। সবচেয়ে ছোটটির বয়স এক বছর। তিনি বলছিলেন, ‘এমনকি এতটুকু বাচ্চাকে এ ওষুধ খাওয়াই আমি।’
অন্যরা ভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট দেখিয়ে বলেন, তারাও তাদের বাচ্চাদের খাওয়ান এসব। তারা যেসব ট্যাবলেট দেখালেন, সাধারণত সেসব বিষন্নতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় ব্যবহার করেন চিকিৎসকেরা।
এর পরিণতি কী?
এ ব্যাপারে চিকিৎসকেরা বলেন, যেসব শিশু–কিশোর অপুষ্টির শিকার, তাদের এই ওষুধ খাওয়ানো হলে পাকস্থলি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ, ঘুম ও আচরণে বিশৃঙ্খলা।
স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে গিয়ে ওই প্রতিনিধিরা দেখেন, ১০ আফগানিতে (আফগানিস্তানের মুদ্রা) বা এক টুকরা রুটির মূল্যে এ ওষুধ কেনা যায়। তারা কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন। জেনেছেন, বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরাই অল্প কিছু রুটি ভাগাভাগি করে খেয়ে টিকে আছেন। একজন নারী তাদের বলেন, তারা সকালে শুকনা রুটি খান। আর রাতে রুটি ভিজিয়ে খান; যাতে তা নরম হয়।
জাতিসংঘ বলেছে, আফগানিস্তানে এখন এক ‘মানবিক বিপর্যয়’ দেখা দিতে চলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৩
আপনার মতামত জানানঃ