রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি যখন সংগঠিত হয়ে মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে সারা দেশে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, তৃণমূলের সম্মেলন ও কমিটি গঠন এবং সরকারি কাজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছেই। নিজেদের দলাদলির প্রভাবে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও রক্ত ঝরছে, ঘটছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রাণহানির ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা বলছেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন তারা রাজপথে মোকাবিলা করবেন। ১০ ডিসেম্বর বিরোধী রাজনৈতিক দলটির পক্ষ থেকে ঢাকায় যে মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে, তাও ঠেকিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তারা। কিন্তু ক্ষমতাসীন এই আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সারা দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাত অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে রাজপথে মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে ৮ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ৮৯৫ জন। এ সময় তারা ৭৩টি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
চলতি অক্টোবর মাসেও প্রাণহানির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। সে হিসাবে প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কমপক্ষে ১৫ জন। আর আহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ৬১, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ ১, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ১, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ৩, যুবলীগের সঙ্গে যুবলীগ ১ এবং ছাত্রলীগ নিজেরা ৬টি ঘটনায় মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। যুগান্তরের একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, চলতি বছরে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে অন্তত ৮৪ বার।
আসকের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত ৯ মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৪৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এসব সংঘর্ষের নেপথ্যে কাজ করছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব।
দ্বন্দ্বের কারণ যখন ক্ষমতা দখল
২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা পরের বছর জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে মরিয়া নির্বাচনি এলাকাগুলোর একাধিক নেতাকর্মী। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নির্বাচনের আগেই তৃণমূল আওয়ামী লীগের কমিটিগুলো নিজেদের কব্জায় নিতে চাচ্ছেন। দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে মূলত এ নিয়েই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, একটি বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার বিরোধ তৈরি হতেই পারে। সে বিরোধ নিরসনে সব সময় স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে দ্ব›দ্ব-সংঘাত মিটমাটও হয়। আওয়ামী লীগে কোথাও দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো দ্ব›দ্ব বা বিরোধের জেরে যদি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে তার জন্য দায়ীরা শাস্তি এড়াতে পারে না। সংঘাতের বিষয়ে কাউকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি সুসংগঠিত, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় রাজনৈতিক দল। গত ১৪ বছর এই দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময়ে বিভিন্ন দল থেকে অনেকেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। এই অনুপ্রবেশের কারণে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন বা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, অভ্যন্তরীণ দ্বদ্বের কারণে কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ হলে তা দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রচলিত আইনের বাইরেও এজন্য রয়েছে কঠিনতর দলীয় শাস্তির বিধান। কাজেই দলের শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ করে কোনো নেতাকর্মীর পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
কেস স্ট্যাডি
জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জে গত ১৭ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির হোসেন মোলা নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে নয়টার দিকে মনির হোসেন মোলা মারা যান। এলাকায় প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুরুজ এবং ইউনিয়নটির ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি আলী হোসেনের অনুসারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। ওইদিন তাদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়।
নাটোরের সিংড়ায় ৯ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ২ জন নিহত হয়েছেন। সুকাশ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আফতাব উদ্দিনকে (৫০) সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। এ সংঘর্ষে গুরুতর আহত রুহুল আমিন (৪৫) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন মৃত্যুবরণ করেন।
ঝিনাইদহে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষের ধাওয়ায় মোটরসাইকেলে পালানোর সময় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সংগঠনটির তিন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ৭ অক্টোবর শুক্রবার সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের ঘোষপাড়ায় রাতের এ ঘটনায় নিহতরা হলেন-ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুশাবাড়িয়া গ্রামের বাদশা বিশ্বাসের ছেলে ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি সাইদুর রহমান মুরাদ, একই কলেজের শিক্ষার্থী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার বলেশ্বর গ্রামের মৃত গোলাম মোস্তফার ছেলে তৌহিদুল ইসলাম তৌহিদ ও যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার পাড়দিয়া গ্রামের রাখাল চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে সমরেশ বিশ্বাস। মোটরসাইকেল চালিয়ে আঠারোমাইল নামক স্থানে পৌঁছালে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি বোঝাই ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খান তারা। এতে ঘটনাস্থলেই মুরাদসহ তিনজন নিহত হন।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে ঘিরে দুই গ্র“পের মধ্যে সংঘর্ষে দুই নেতাসহ ৫ জন আহত হয়েছেন। ১০ অক্টোবর উপজেলার সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সম্মেলন শুরুর আগে এ সংঘর্ষ হয়। আহত ব্যক্তিরা হলেন-চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও পুনট্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জ্যোতিশ চন্দ্র রায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, জ্যোতিষ চন্দ্র রায়ের সমর্থক আওয়ামী লীগ কর্মী এনামুল ইসলাম (৩৫), নিবারণ রায় (৪৮) এবং উপজেলা যুবলীগের সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হকের সমর্থক কবির হোসেন (২৮)।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ১৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের ডহর মারুয়াদী এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষের এই ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন-বিল্লাল হোসেন, আঁখি, ইমরান, ইমন, নুরুল ইসলাম, জরিনা বেগম, আবদুর রহমান, জিয়াউদ্দিন, বিউটি বেগম, আরিফ ও মকবুল।
৯ অক্টোবর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে আওয়ামী লীগের দুই গ্র“পের সংঘর্ষে ছয়জন আহত হয়েছেন। পরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে নয় বছর পর ডাকা সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। উপজেলার জয়াগ মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নোয়াখালী-১ আসনের সংসদ-সদস্য এইচএম ইব্রাহিমের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ থামাতে তিনি (এমপি) ব্যর্থ হন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন-জয়াগ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাফিজ তানভীর, যুগ্ম-আহ্বায়ক আব্দুর রহিম, ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ইসমাঈল হোসেন বাবু, জয়াগ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাব্বি।
৪ অক্টোবর কুমিলার দেবিদ্বারে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে হামলার শিকার হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ। তার অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ-সদস্যের অনুসারীরা ওই হামলা চালায়। এর আগে ১৬ জুলাই ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য রাজি মোহাম্মদ ফখরুলের সঙ্গে আবুল কালাম আজাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন কমিটি নিয়ে মতবিরোধে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। এর জেরে দেবিদ্বারে দুই নেতার অনুসারীরা রাস্তা অবরোধ, মিছিলসহ পালটাপালটি নানা কর্মসূচি পালন করে।
২ অক্টোবর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুটি পৃথক সংঘর্ষে জড়ান। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩ জন। তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে জানা গেছে।
২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ঢাকার লালবাগ থানা ও অধীনস্থ মহানগরীর ওয়ার্ডগুলোর সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতেই কয়েক দফায় সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের দুপক্ষ। পরে আবারও সংঘর্ষের আশঙ্কায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর চকবাজার থানা ও অধীনস্থ ওয়ার্ডগুলোর সম্মেলন স্থগিত করা হয়। সম্মেলনকেন্দ্রিক সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরকে ২৩ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।
সেপ্টেম্বরে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ-সদস্য, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরোধকে কেন্দ্র করে এই অব্যাহতির ঘটনা ঘটে বলে আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে। ২৮ আগস্ট দুপক্ষের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়। মার্চে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাহফুজ আলম লিটন সরদারকে পিটিয়ে জখম করে পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারীরা।
৯ আগস্ট শরীয়তপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে ওয়াহিদ খান (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হন। এ সময় উভয়পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়। নিহত ওয়াহিদ খান শরীয়তপুর উপজেলার চিকন্দি ইউনিয়নের আবুড়া গ্রামের মৃত রমিজ উদ্দিন খানের ছেলে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইদ্রিস খাঁ ও মজিবুর খাঁ নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পালং মডেল থানা পুলিশ।
এসডব্লিউএসএস১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ