ব্রাজিলের একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ জীবিত সদস্য, যিনি ‘দ্য ম্যান অব হোল’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন, মারা গেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চলে বাস করা রহস্যময় এক ‘গর্তমানব’ অধ্যায়।
একটি উপজাতি সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তি ছিলেন তিনি, তাকে বলা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গতম মানুষ।
আদিবাসী সংস্থা ফুনাইয়ের বরাতে সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে সোমবার তার মৃত্যুর খবর দেয়া হয়েছে।
দীর্ঘ ২৬ বছর আগে বলিভিয়া সীমান্তের কাছে আমাজনের গভীরে ব্রাজিলের রন্ডোনিয়া রাজ্যে গর্ত খুঁড়ে থাকতে শুরু করেন এই রহস্যমানব। তার নাম ও ভাষা কিছুই জানা যায়নি।
প্রাণীদের ফাঁদে ফেলা এবং লুকিয়ে রাখার জন্য গভীর গর্ত তৈরি করার অভ্যাস ছিল এই ব্যক্তির। এ জন্য তাকে বলা হতো গর্তমানব। গত ২৩ আগস্ট তাকে তার কুঁড়েঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
সব ধরনের যোাগযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তির ওপর নজরদারি অব্যাহত রাখছিল। মাঝেমধ্যে তার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে যাওয়া হতো।
সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তার গোত্রের বাকি মানুষেরা ১৯৭০-এর দশক থেকে কয়েক দফা আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রধানত গবাদি পশুপালক এবং ভূমি দখলকারীরা এসব হামলা চালান। সংস্থাটির গবেষণা এবং অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর ফিওনা ওয়াটসন বলছেন, এই ব্যক্তির নাম কেউ জানতেন না, এমনকি তার গোত্র সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু জানা নেই কারও। এখন তার মৃত্যুর সাথে তার গোত্রের ওপর চালানো গণহত্যা সম্পূর্ণ হলো।
একটি উপজাতি সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তি ছিলেন তিনি, তাকে বলা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গতম মানুষ।
‘এটি আসলেও গণহত্যা। কারণ জমি এবং সম্পদের জন্য ক্ষুধার্ত মানুষরা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সম্পূর্ণ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিল।’
২৩ আগস্ট ফুনাইয়ের কর্মকর্তারা একটি কুঁড়েঘরে ওই ব্যক্তির মৃতদেহটি একটি ঝুপড়ির মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেন। হামলা বা অন্য কারও উপস্থিতির কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।
ফুনাই বলছে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তবে ফেডারেল পুলিশ তার মরদেহের ফরেনসিক পরীক্ষা করবে।
সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তার জীবনযাত্রার কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে। তিনি ভুট্টা এবং পেঁপেসহ কিছু শস্য রোপণ করেছিলেন এবং খড়, কাঠ ও গাছের পাতা দিয়ে ঘর তৈরি করেছিলেন।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছেন এই রহস্যমানব। ফেডারেল পুলিশ তার মরদেহের ফরেনসিক পরীক্ষা করবে।
এর আগে ২০০৯ সালের শেষ দিকে এই ব্যক্তি বন্দুকধারীদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন বলে তথ্য দিয়েছে আদিবাসী অধিকার গোষ্ঠী সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড্রোন ও ত্রিমাত্রিক স্ক্যানার ব্যবহার করে ওই উপজাতির ব্যাপারে জঙ্গলে পর্যবেক্ষণ করে একই রকম আরও ৫৩টি কুঁড়েঘর চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরের ভেতরে পাওয়া গেছে একটি করে গর্ত।
ব্রাজিলের এই আমাজান বনাঞ্চলে যোগাযোগ এড়িয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা এমন অন্তত ১১৪ জন আদিবাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে আমাজনে প্রথমবারের মতো রহস্যমানবকে দেখতে পান তারা। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় পর আবার তাকে দেখা যায় ২০১৯ সালে। তার বয়স পঞ্চাশের আশপাশে।
আমাজনের বুকে বহু বছর ধরে বাস করে আসা এক আদিম উপজাতির শেষ প্রতিনিধি এই রহস্যমানব। ১৯৯৫ সালে তার উপজাতির জীবিত পাঁচজন মারা যান আধুনিক পৃথিবীর বাসিন্দাদের আক্রমণে।
ফুনাইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ঘাস দিয়ে বানানো কুঁড়েঘরের চারদিকে ভুট্টা ও পেঁপের চাষ করতেন এই ব্যক্তি। শরীরে থাকত পশুর ছাল। সুড়ঙ্গ খোঁড়া, শিকারে যাওয়া আর মাছ ধরার জন্য তিনি ব্যবহার করতেন আদিম ধারালো যন্ত্র।
ব্রাজিলে ৩০৫টিরও বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে যাদের সম্পর্কে মূলধারার সমাজ জানে। তারা ২৭৪টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। অন্যদিকে বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং যোগাযোগহীন উপজাতির সংখ্যা ৫০ এরও বেশি।
সারা পৃথিবীতে এমন শতাধিক জনগোষ্ঠী আছে। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাস করে আমাজন এলাকায়। এদের সাথে মূলধারার সমাজের সম্পর্ক ‘শান্তিপূর্ণ’ নয়। তাদের জনসংখ্যা কত, তারা কী ভাষায় কথা বলে তার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ