পৃথিবীর অক্সিজেন হিসাবে পরিচিত ও সবচেয়ে বড় চিরহরিৎ বনাঞ্চল ব্রাজিলের আমাজন উজাড় করার মহোৎসব চলছে বহু বছর ধরে। এনিয়ে পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হবার পরও এই অরণ্য ধ্বংসের মোচ্ছবকে থামানো যাচ্ছে না।
সবশেষ উপাত্তে দেখা গেছে, ব্রাজিলের আমাজন অরণ্যে ২০২১ সালে আমাজনে প্রতি ঘণ্টায় ১১১.৬ হেক্টর বা প্রতি মিনিটে ১.৯ হেক্টর জমির বন উজাড় করা হয়। এই হিসাবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮টি গাছ নিধন করা হয়। এদিকে দেশটিতে বন নিধন ২০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ম্যাপ বায়োমাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ব্রাজিলে প্রায় ১৬,৫৫৭ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি নিধন করা হয়েছে। বন উজাড় করা এ এলাকা নর্দার্ন অ্যায়ারল্যান্ডের চেয়েও বড়।
২০২০ সালে ১৩,৭৮৯ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি উজাড় করা হয়েছিল। ২০২১ সালে আমাজনের ৬০ শতাংশ ভূমির গাছপালা নিধন করা হয়। আমাজন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট।
এনজিও, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি কোম্পানির একটি নেটওয়ার্ক ম্যাপবায়োমাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী,প্রধানত চাষাবাদের জন্য এসব জমির গাছপালা কেটে ফেলা হয়। হিসাব অনুযায়ী মোট নিধন হওয়া বনভূমির প্রায় ৯৭ শতাংশ কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। সেখানে বনভূমি উজাড়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবৈধ খনন কাজ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে ব্রাজিলের অতি ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর নির্দেশে ব্যাপকভাবে বন উজাড় করা হয়েছে। এ সময়ে ব্রাজিল প্রায় ৪২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার বন হারিয়েছে। অধিকাংশই রিও ডি জেনিরো রাজ্য এলাকার বন উজাড় করা হয়েছে।
আমাজনে প্রতি ঘণ্টায় ১১১.৬ হেক্টর বা প্রতি মিনিটে ১.৯ হেক্টর জমির বন উজাড় করা হয়। এই হিসাবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮টি গাছ নিধন করা হয়। এদিকে দেশটিতে বন নিধন ২০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্পেস রিসার্চের (আইএনপিই) তথ্যমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ব্রাজিলিয়ান আমাজনের ৩ হাজার ৯৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, বন উজাড় এক দশক আগের তুলনায় বলসোনারোর সময় ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, বলসোনারো অর্থনৈতিক লাভের জন্য সক্রিয়ভাবে বন উজাড়কে উৎসাহিত করেছেন। তাছাড়া বন নিয়ে গবেষণা ও সুরক্ষা সংস্থাকে দুর্বল করার জন্যও তারা বলসোনারোকে অভিযুক্ত করেছেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল আমাজন। বনাঞ্চলটি এতো বড় যে, দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম দেশ হতো আমাজন। যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড অনায়াসে ১৭ বার রাখা যাবে এ বনাঞ্চলে। ৯টি দেশ মিলে বিস্তৃত এই বন। এটি একটি এমন ইকোসিস্টেম যা পুরো পৃথিবীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এত বড় বনাঞ্চল ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।
পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
ব্রাজিল থেকে গায়ানা পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চল সেই সংঘর্ষেই জেগে ওঠে। মাঝখানে বয়ে যায় আমাজন নদীসহ অসংখ্য নদনদী। এখানে প্রথম প্রাণের লীলা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। তারপর বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি আর মানুষের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে আমাজন রেইনফরেস্ট।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ