২০২২ সালে করোনার দাপট কমে এলেও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে বিশ্ব অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতেও। এতে ডলার সংকটের পাশাপাশি বাড়ে আমদানি ব্যয়। কমতে থাকে রিজার্ভ। গত ২০ জুলাই যা ৩৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
জুলাইতে বাড়লেও তার আগের কয়েক মাস প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমেছে। সব মিলিয়ে লেনদেনের ভারসাম্যে নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা, রিজার্ভের মজুত চাঙ্গা করা এবং বাজেট ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণে সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিতে চায় সরকার। তবে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। তার মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার সেই শর্ত পূরণ করলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে সরকার একদিকে আর্থিকভাবে হবে ফলে বাজেটে ভর্তুকি কমবে, অন্যদিকে আইএমএফের শর্ত পূরণও হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্যের ক্ষেত্রে কিছুটা চাপে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য ও রাসায়নিক সার আমদানির দায় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে কয়েক মাস ধরে রিজার্ভের মজুত কমছে। বর্তমানে রিজার্ভের মজুত ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
এ অবস্থায় সংস্থাটির কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে সরকার। কিন্তু এ ঋণের জন্য বাংলাদেশে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার শর্ত দিতে পারে আইএমএফ। রাজস্ব এবং আর্থিক খাতের সংস্কারের শর্তও দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন আরও কিছু শর্ত থাকতে পারে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কেরোসিনের দাম বেড়েছে। কেরোসিনের ব্যবহার বেশি হয় গ্রামে। গ্রামে মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনের ভাড়া এমনিতেই বাড়বে। এরই মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে।
সকল প্রকার উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, মানুষ আরও চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। সমাজে অশুভ শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। দেশের অগ্রযাত্রা, স্থিতিশীলতা বিঘ্ন ঘটবে।’
পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। আবার সরকার যদি পরিবহন মালিকদের শর্ত না মানে তাহলে ধর্মঘট হবে। পরে দেখা যাবে যে সরকার এটা মানতে বাধ্য হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাসভাড়া, ট্রাকভাড়া ও লঞ্চসহ নানা পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। এছাড়া কৃষিখাতে প্রচুর ডিজেল ব্যবহার হয়। এবার বৃষ্টি কম হয়েছে, ফলে আমন চাষে সেচকাজে ডিজেলের ব্যবহার বাড়বে। ফলে কৃষি ও শিল্পের খরচ বাড়বে। সব পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতি যেখানে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে সামনে এটা ৮ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ হবে।
এদিকে গতকাল রোববার বিশিষ্ট ২৬ নাগরিকের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অশুভ শক্তির হাতকে আরও শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি, জনজীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এতে বলা হয়, ‘দীর্ঘ সময় থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনা বিপর্যয়ে এমনিতেই দেশে দেশে প্রাণহানি, উৎপাদন বন্ধ, বাণিজ্য, শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ, হতাশা, সামাজিক অবক্ষয়, বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করছে।’
‘উপর্যুপরি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য সংকটসহ নানান জটিলতার পরিস্থিতিতে দেশে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে মানুষ নানান সংকটে নিপীড়িত।’
‘এই সংকটাপন্ন অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ন্যূনতম যৌক্তিকতা থাকলেও হঠাৎ করে পেট্টোল-ডিজেল, অকটেন, কেরোসিনের মূল বৃদ্ধির অযৌক্তিক ঘোষণা দেশে নৈরাজ্য ডেকে আনবে।’
‘এর ফলে সকল প্রকার উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, মানুষ আরও চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। সমাজে অশুভ শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। দেশের অগ্রযাত্রা, স্থিতিশীলতা বিঘ্ন ঘটবে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, দাতা সংস্থার দ্বারস্থ হয়ে সরকার দাতা সংস্থার দেওয়া নির্দেশনাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশকে মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় সরকার ঘোষিত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার করে জাতীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ