ভারতে গত দুই বছরে চার হাজার চারশ ৮৪ জন কারাবন্দির মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে। দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) লোকসভার অধিবেশনে এমন তথ্য ওঠে আসে।
অধিবেশনে লিখিতভাবে রাজ্যভিত্তিক কারাবন্দির মৃত্যুর তথ্য দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সংসদে জানান, ২০২০ এবং ২০২১ সালে উত্তরপ্রদেশে ৯৫২ জন জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে ৪৫১ জন এবং ২০২১ সালে ৫০১ জন বন্দি মারা গেছেন। অন্যদিকে, গত দুই বছরে পশ্চিমবঙ্গে জেলবন্দির মৃত্যুর সংখ্যা ৪৪২। ২০২০ সালে ১৮৫ এবং ২০২১ সালে ২৫৭।
উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের পর তৃতীয় স্থানে আছে বিহার। নীতীশ কুমারের রাজ্যে দুই বছরে মোট ৩৯৬ জন জেলবন্দির মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতে গত এক বছরে জেলবন্দি মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে।
২০২০ সালে তামিলনাড়ুতে বন্দিমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬৩। ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ১০৯। তবে গোয়া এবং কর্ণাটকে জেলবন্দি মৃত্যুর সংখ্যা ১০-এর কম বলে জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
উত্তর ভারতে আবার জেলবন্দি মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ এবং ত্রিপুরায় ১০টির কম বন্দির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত দুই বছরে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে বন্দিমৃত্যুর সংখ্যা শূন্য।
কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পুলিশের এনকাউন্টারে দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে ২৩৩ জনের।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ভারতে পুলিশি হেফাজতে অসংখ্য সন্দেহভাজন ব্যক্তি মারা যায়৷ আদালত এইসব মৃত্যুর তদন্তের আদেশ দিলেও, কারাগারে থাকাকালীন মৃত্যুর জন্য কোনো পুলিশ কর্মচারীকেই অভিযুক্ত করা হয়নি৷
দেশটিতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটলেও বিচার হচ্ছে না দোষীদের। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে গত ২০ বছরে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ৮৯৩টি মামলা করা হয়েছে। ওই মামলাগুলোতে ৩৫৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২৬ পুলিশ।
এনসিআরবি একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ২০০৬ সালে হেফাজতে মৃত্যুর জন্য সর্বোচ্চ ১১ পুলিশকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে সাতজন উত্তরপ্রদেশে এবং চারজনকে মধ্যপ্রদেশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
পুলিশ এইসব হেফাজতকালীন মৃত্যুর ঘটনাকে হয় আত্মহত্যা, না হয় প্রাকৃতিক কারণ কিংবা শারীরীক অসুস্থতা বলে দাবি করে৷ পুলিশের বিরুদ্ধে মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের আনা নির্যাতনের অভিযোগকে নস্যাত করে দেওয়া হয়৷
ভারতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) নামে এক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এইসব হেফাজতকালীন মৃত্যুর জন্য আদালত তদন্তের আদেশ দিলেও এ পর্যন্ত কোনো পুলিশ কর্মচারিকে না দায়ী করা হয়েছে, না অভিযুক্ত করা হয়েছে৷
রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ এইসব হেফাজতকালীন মৃত্যুর ঘটনাকে হয় আত্মহত্যা, না হয় প্রাকৃতিক কারণ কিংবা শারীরীক অসুস্থতা বলে দাবি করে৷ পুলিশের বিরুদ্ধে মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের আনা নির্যাতনের অভিযোগকে নস্যাত করে দেওয়া হয়৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, পুলিশ বাহিনীতে দায়বদ্ধতা এবং মানবাধিকার সচেতনতার অভাব দূর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকে একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি৷ দিলে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় রাশ টানা সম্ভব হতো৷ পুলিশ বিভাগ যদি নিয়মবিধি মেনে চলে, তাহলে নির্যাতনজনিত মৃত্যুর ঘটনা কমে যাবে৷ তাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ঐ রিপোর্টে বলা হয়, আইনের শাসন তখনই হবে, যখন পুলিশ বিভাগের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত হবে৷
মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদালতের আদেশে তদন্ত শুরু হলেও, দোষী পুলিশ কর্মচারীদের বাঁচাতে বা তাদের আড়াল করারই চেষ্টা করা হয় বেশি৷ আসামিদের গ্রেপ্তার করার এবং হেফাজতে নেবার উপযুক্ত নিয়মবিধি পুলিশ পালন করে না৷ নিয়ম অনুসারে, আসামিকে হেফাজতে নেবার আগে তার ডাক্তারি পরীক্ষা করাতেই হবে এবং গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কথিত আসামিকে ম্যাজিস্ট্রের সামনে হাজির করাতে হবে৷ কিন্তু আসামিকে জেরা করে বিনা নির্যাতনে কিভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হয়, সে বিষয়ে ভারতীয় পুলিশ বাহিনীর উপযুক্ত ট্রেনিং বা পরিকাঠামো নেই৷ ফলে সহজ পন্থা হিসেবে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যেমন প্রচণ্ড মারধর করে বা কখনও হাত-পা বেঁধে কড়িকাঠে ঝুলিয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়৷
তারা বলেন, আইন বলবত করার প্রাথমিক দায়িত্ব পুলিশের৷ সেই পুলিশই যদি সেটা পালন না করে, তাহলে পুলিশ থাকা কেন?
দোষীদের শাস্তি দাবি করে তারা বলেন, নির্যাতনের অভিযোগে শাস্তির মুখোমুখি করা হলেই পুলিশ শিখবে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্যাতন করা গ্রহণযোগ্য নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৩৪
আপনার মতামত জানানঃ