ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের ভয়াবহ জলবায়ু সংকট এখন আর শুধু কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার বিষয় নয়—এটা একটি সামাজিক, প্রশাসনিক এবং নৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। হিমাচল প্রদেশে মাত্র এক মাসের বর্ষায় ১৯টি মেঘফাটা বৃষ্টি ও ২৩টি চকিত বন্যায় ৭৮ জন প্রাণ হারানো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, বরং এই ধরনের বিপর্যয়গুলো ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং তা স্পষ্টতই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া।
হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, কেরালা বা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর মতো পাহাড়ি এলাকাগুলো বরাবরই প্রাকৃতিক দিক থেকে সংবেদনশীল। কিন্তু গত এক-দেড় দশকে এই রাজ্যগুলোর উপর যে ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকাংশেই মানুষের অসচেতন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার ফসল। যেখানে ২০২৩ সালে হিমাচলে ৪২৮ জন মানুষ মারা যান, সেখানে ২০২৪ সালে সংখ্যাটা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৮ জনে। শুধু মানুষ নয়, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে হাজারো বাড়ি, গবাদি পশু ও গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর।
আইআইটি রোপারের একটি সমীক্ষা বলছে, হিমাচলের ৪৫ শতাংশ এলাকা ধসপ্রবণ। অথচ সেইসব এলাকা চিহ্নিত থাকলেও সেখানে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বহুতল বাড়ি, রাস্তা এবং সুড়ঙ্গ নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের অনুমতিতে নিয়ম ভেঙে পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠছে বিশাল সব স্থাপনা। এটি শুধু পরিবেশ নয়, বাস্তুতন্ত্রেরও অপূরণীয় ক্ষতি করছে।
প্রবীণ পর্বতপ্রেমী তথাগত সেন বলছেন, “আগে পাহাড়ে যেসব জায়গা বর্ষার পানির স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য নির্ধারিত ছিল, সেসব জায়গায় কেউ বাড়ি বানাত না। এখন সব জায়গায় অনুমতি দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই জল আটকে যায়, মাটি সরে যায়, ধস নামে।” এসব অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ প্রকল্প পাহাড়ের ভৌগলিক গঠনকেই ভেঙে দিচ্ছে।
পরিবেশবিদ মল্লিকা জালান খুব সহজ করে যে কথাটা বলছেন, তা হলো—এটা শুধুই সরকারের দায় নয়, আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাসের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অতি ব্যবহারে জল, গাছ কাটার ধুম, প্লাস্টিকের ব্যবহার, উড়োজাহাজে অকারণ ভ্রমণ—এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের। অথচ জনগণ এবং রাজনীতিকদের মধ্যে এই বিষয়ে কোনো সংলাপ নেই। তারা একে অপরের দিকে দায় চাপিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।
সাংবাদিক শরদ গুপ্তার কথাতেও একই হতাশার সুর—”পরিবেশ সংরক্ষণ রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠেনি। দিল্লির দূষণ, খড় পোড়ানো, বাজি ফাটানো—এই চক্র প্রতি বছর চলে যাচ্ছে, কোনো বদল নেই।” এই উদাসীনতার মূল কারণ, সমাজে সচেতনতার অভাব। আমরা যেন বড় কোনো দুর্ঘটনা না হলে কিছুই বুঝতে চাই না।
জনসংখ্যার চাপ ও পর্যটন এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। হিমাচলের মতো জায়গায় এখন শুধু রাস্তায় নামলেই গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি চোখে পড়ে। তিলমাত্র ফাঁকা নেই। বহু পর্যটক হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য দেখতে ছুটে যান, কিন্তু সেই পর্যটন যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, পরিবেশবান্ধব না হয়, তবে তা নিজেই ধ্বংসের কারিগর হয়ে দাঁড়ায়।
মল্লিকা বলেন, “আমি নিজে ছোটবেলায় কেদারনাথ গিয়েছিলাম। এখন গেলে ভয় পাই। মনে হয় ধস বা বন্যায় আটকে যাব।” এই ভয়টাই এখন বাস্তব। শুধু পাহাড় নয়, এই বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারতসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়।
তবে সমস্যার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উদাসীনতা। আমাদের সমাজে এখনো পরিবেশ নিয়ে চর্চা গৌণ, ভোটের সময় এই ইস্যু আলোচনার টেবিলে আসে না। জনগণ ভাবে, এগুলো সরকারের কাজ। আবার সরকার ভাবে, লোকজন সচেতন না হলে কী করেই বা হবে। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে।
যদি হিমাচলের এই বিপর্যয় আমাদের কিছু শেখায়, তবে তা হলো—প্রকৃতি আর ধৈর্য ধরছে না। আমাদের অভ্যাস, উন্নয়ন ভাবনা, রাজনীতির প্রাধান্য ও নীতিনির্ধারণ—সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। পাহাড়ের মাটি যেমন নরম, তেমনি ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ব্যবস্থাও। এখনই যদি সকলে মিলে দায়িত্ব না নেই, তাহলে আগামী বর্ষায় আমরা আবার নতুন কিছু সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করবো—নতুন কত প্রাণ যাবে, কত ঘর মাটি হবে—এই হিসেবের জন্য। এটা থামানো আমাদেরই কাজ।
আপনার মতামত জানানঃ