তাপপ্রবাহ ও দাবানলে পুড়ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। অতি গরমে গত মঙ্গলবার থেকে স্পেন ও পর্তুগালে ৩০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
স্পেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার দেশে তাপদাহের প্রথম তিনদিনেই ৮৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
চলতি বছরে স্পেনে দ্বিতীয়বারের মতো তাপপ্রবাহ চলছে। প্রথম তাপপ্রবাহ গত ১১ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে স্পেনজুড়ে ৮২৯ জনের মতো লোকের মৃত্যু হয়। তখন ৪৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল দেশটিতে।
এই সময়ে মানুষকে সুস্থ থাকতে বার বার বিশুদ্ধ পানি পানের পাশাপাশি ছায়াঘেরা স্থানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলছে, পর্তুগাল, স্পেন ও ফ্রান্সে তীব্র তাপপ্রবাহ ও দাবানল আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ হতে পারে। সেই সঙ্গে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইউরোপের অন্যান্য অংশেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে এই তাপপ্রবাহ ও দাবানল।
ব্রিটেনের তাপমাত্রা ইতোমধ্যেই রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ব্রিটেনের আবহাওয়া দফতর ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের বেশিরভাগ অংশে চরম তাপপ্রবাহের বিষয়ে কড়া সতর্কতা জারি করেছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে রবিবার ও সোমবার তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে অস্বাভাবিক উচ্চে পৌঁছাতে পারে।
সোমবার (১৮ জুলাই) এবং মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) ইংল্যান্ডের কিছু অংশে ‘চরম তাপ’ সতর্কতা জারি করেছে ব্রিটেনের আবহাওয়া পূর্বাভাসদাতা সংস্থা। দেশটির মেট অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ পল গুন্ডারসেন জানান, ‘সম্ভবত আগামী সপ্তাহের শুরুতে রেকর্ড-ব্রেকিং তাপমাত্রা হতে পারে।’
পর্তুগাল, স্পেন ও ফ্রান্সে তীব্র তাপপ্রবাহ ও দাবানল আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ হতে পারে। সেই সঙ্গে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইউরোপের অন্যান্য অংশেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে এই তাপপ্রবাহ ও দাবানল।
তিনি বলেন, ‘‘শহুরে এলাকায় রাতের তাপমাত্রা ব্যতিক্রমীভাবে উষ্ণ হতে পারে। এটি সম্ভবত জনগণ এবং অবকাঠামোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।’’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ রেকর্ড করা তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশটি উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে লড়াইয়ে সক্ষম নয় বলে জানিয়েছেন ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং-এর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ হান্না ক্লোক।
তিনি বলেন, ‘এখানে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে এবং তা মানিয়ে নেওয়ার জরুরি প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যে এই ধরনের তাপমাত্রার সাথে মোকাবিলা করা কঠিন কারণ আমরা তাদের সাথে অভ্যস্ত নই।
এদিকে পর্তুগালের তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে পৌঁছেছে। সেখানে তাপপ্রবাহের চরম লাল সতর্কতা জারি করে মানুষের জীবন-হুমকির মুখে বলে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। একই ধরনের সতর্কতা জারি করা হয়েছে স্পেন-ফ্রান্সেও। পর্তুগাল, স্পেনের পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সে ২০টিরও বেশি দাবানলের খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে, ৭০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কারণে ইতালিতে তীব্র দাবদাহ দেখা দিয়েছে। ইতালি পো নদী বরাবর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। এই নদীটি দেশের কৃষি উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অবদান রাখে। আগামী সপ্তাহে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দাবানলের বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে ইউরোপের গোটা দক্ষিণাঞ্চল এবং মরোক্কো। ইতালি এবং ক্রোয়েশিয়াও এ সপ্তাহে দাবানলের খবর দিয়েছে। ওদিকে, তীব্র বাতাসের কারণে গ্রিসের পাঁচটি অঞ্চলে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে বলে সতর্ক করেছেন সংরক্ষণ কর্মকর্তারা।
গ্রিসের কেন্দ্রস্থলের দুটি স্থানে শুক্রবার দাবানলের আগুন জ্বলার খবর পাওয়া গেছে। রাজধানী এথেন্সের দক্ষিণ-পূর্বের অধিবাসীদের অবিলম্বে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জরুরি সেবা বিভাগ।
করোনা মহামারির কারণে ইতোমধ্যে মানুষের স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
নেচার জিওসায়েন্স জার্নাল আটলান্টিক মহাসাগরের ওপরে একটি উচ্চ চাপ সম্প্রসারণের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সাম্প্রতিক একটি মডেলিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার গ্লোবাল অ্যাটমোস্ফিয়ার ওয়াচ প্রোগ্রামের বৈজ্ঞানিক লরেঞ্জো ল্যাব্রাডর বলেন, আজোরেস হাই নামে পরিচিত এই পদ্ধতিতে দেখা গেছে যে গত ১ হাজার বছরের মধ্যে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ সবচেয়ে শুষ্ক অবস্থার দিকে ধাবিত হবে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বায়ু দূষণ হচ্ছে অকাল মৃত্যু এবং রোগের একটি প্রধান কারণ। বর্তমানে এটি হচ্ছে ইউরোপে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি বছর ইউরোপে বায়ু দূষণের কারণে ৩ লাখের বেশি মানুষ অকালে মারা যায় এবং বিশ্বব্যাপী সত্তর লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ