সারা দেশে গত মাসের মাঝামাঝি বয়ে যায় তীব্র তাপপ্রবাহ। ঈশ্বরদীতে গত ১৭ এপ্রিল তাপমাত্রা পৌঁছে প্রায় এক দশকের সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। প্রতি বছরই গ্রীষ্মের শুরুতে এমন তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে সারা দেশের ওপর। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সামনের বছরগুলোয় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে দেশী-বিদেশী সংস্থার পূর্বাভাস রয়েছে। বিশেষ করে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্য অনেক খাতের মতো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এরই মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাপপ্রবাহ। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একই স্থানে পরপর দুদিন রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর জন্য প্রধানত তাপমাত্রাকেই দায়ী করেছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। দেশের সড়ক যোগাযোগ খাতেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবের বড় আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দিতে পারছেন না তারা।
কেন ভেঙে পড়বে যোগাযোগ ব্যবস্থা?
তাদের ভাষ্যমতে, দেশে রাস্তা তৈরির প্রধান উপকরণ হলো অ্যাসফল্ট। বিটুমিনের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে এটি তৈরি করা হয়। অ্যাসফল্টের রাস্তা তাপ শোষণ করে বেশি। পরিবেশের ওপরও রয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। এ ধরনের সড়কে গাড়ির টায়ারের ক্রমাগত ঘর্ষণ যুক্ত হওয়ায় বাতাসের চেয়ে রাস্তার তাপমাত্রা বেশি হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, তাপপ্রবাহের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ সূর্যের উত্তাপ শোষণ করায় রাস্তার তাপমাত্রা কখনো কখনো ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছতে পারে। আর অ্যাসফল্টের প্রধান উপকরণ বিটুমিন (পিচ) গলতে শুরু করে ৫৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। বিটুমিনের সঙ্গে মানহীন উপকরণের ব্যবহার করা হলে অ্যাসফল্ট গলে রাস্তা দ্রুত দেবে যাওয়া ও যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ার জোর আশঙ্কা তৈরি হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে গত বছর তাপমাত্রা আকস্মিকভাবে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। এ সময় অ্যাসফল্ট গলে রাস্তাঘাট ডেবে যাওয়া, রেললাইন বেঁকে যাওয়া এমনকি বিমানবন্দরের রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় খরা ও তাপপ্রবাহ এখন স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সামনের দিনগুলোয় এর মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নানা জায়গায় মানহীন উপকরণ ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে।
যুক্তরাজ্যে এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় স্থানে স্থানে যানবাহনের গতি সীমিত করার পাশাপাশি অ্যাসফল্টের রাস্তাগুলোকে এখন কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে প্রতিস্থাপনের আলোচনা চলছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের সড়কেও অ্যাসফল্টের পরিবর্তে কংক্রিটের ব্যবহার শুরু করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সড়ক যোগাযোগ খাতে তাপপ্রবাহসহ আরো অনেক সমস্যার মোকাবেলা করা সহজ হয়ে আসবে।
ইতিমধ্যেই বিঘ্নিত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা
এরই মধ্যে তাপপ্রবাহের প্রভাবে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার নজির সামনে এসেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দরিয়ারপুর এলাকায় গত মাসের শেষ দিকে পর পর দুইদিন বেঁকে যায় রেললাইনের পাত। ২৮ এপ্রিল বেঁকে যাওয়া রেলে চলতে গিয়ে লাইনচ্যুত হয় একটি মালবাহী ট্রেন। পরদিন একই স্থানে আবারো রেললাইন বেঁকে গেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মধ্যে ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়। এ বিষয়ে রেল কর্তাদের বক্তব্য হলো অতিরিক্ত উত্তাপে প্রসারিত হয়ে বেঁকে গেছে ইস্পাতে নির্মিত রেললাইন। এ কারণেই ঘটেছে ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনাটি।
তবে শুধু অত্যধিক গরমের কারণে রেলপথ বেঁকে যাওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য হলো প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, মেয়াদোত্তীর্ণ রেল ব্যবহার ও রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর না থাকার বিষয়টিও এখানে বড় প্রভাব ফেলেছে। বিষয়গুলো নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এখনই যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরো উষ্ণায়িত পরিবেশে বড় কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
অধিক গরমে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেলের পাত বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও প্রতিবেশী ভারতে এ ধরনের কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ ঘটনাটিও এড়ানো সম্ভব ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘পরিবেশের ওপর কালো রঙের বিটুমিনের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি বিটুমিন গরমে নরম হয়ে যায়। সে হিসেবে উন্নত বিশ্বে মেইনটেন্যান্সের ব্যয় হ্রাস এবং শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কংক্রিটের পেভমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এর রঙ ফেয়ার কালার। তাপ শোষণ করে না এবং রাতের বেলা সড়কে এত বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জারও প্রয়োজন হয় না। এটা উজ্জ্বল। আলো প্রতিফলন করে দেয়।
পশ্চিমা দেশগুলোয় জনগণই শহর এলাকায় কংক্রিটের পেভমেন্ট ব্যবহার করতে বাধ্য করে। কারণ বিটুমিনের রাস্তা থাকলে জানালা খুললেই রাস্তা থেকে লু হাওয়া আসে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর রাস্তা বানালে ১০-১৫ বছর অন্তত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিটুমিনে তৈরি করা রাস্তাগুলো টেকসই হচ্ছে না। টেকসই হওয়ার জন্য কংক্রিটের পেভমেন্ট দরকার। এক্ষেত্রে পরিবেশও ঠিক থাকে। বেশি বেশি রক্ষণাবেক্ষণেরও প্রয়োজন হয় না। এখন থোক বরাদ্দগুলো রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণেই চলে যাচ্ছে। এজন্য আমি বলব অনেকগুলো কারণেই পরিবেশবান্ধব কংক্রিটের পেভমেন্ট ব্যবহার করতে হবে।’
যদিও সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা দাবি করছেন, আবহাওয়া অনুযায়ী বিটুমিনের মান ও মিশ্রণ ব্যবহারের মাধ্যমেও এ সংকট মোকাবেলা করা যায়। সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিক সময়ে রাস্তার বিটুমিন পাল্টে দিয়েছি। ঢাকা-সিলেট, সিলেট-তামাবিল—যতগুলো টেন্ডার হচ্ছে, সবখানেই আমরা মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করছি। আবহাওয়া বিবেচনায় বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ করা যায়। যখন যে গ্রেড প্রয়োজন সেটা ব্যবহার করা যাবে।
এছাড়া পাথর ও বালি মিশিয়ে কী পরিমাণ বিটুমিন লাগবে তা নির্ধারণ করা যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করলে বিটুমিন বেশি লাগবে। বিটুমিনের কাজে নির্ধারিত ডিজাইন আছে। সেটা বিবেচনা করেই আমরা বিটুমিন ব্যবহার করি।’
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সাধারণত বাহ্যিক তাপমাত্রার চেয়ে রেল বা রেলের পাতের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে। লোহার তাপ ধারণক্ষমতার কারণেই এমনটি ঘটে। এজন্য রেলপথ তৈরির সময় রেললাইনগুলো জোড়া দেয়ার স্থানে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখা হয়। যেন অধিক তাপমাত্রার কারণে রেললাইন লম্বা হয়ে গেলেও ফাঁকা জায়গাটি সেটা সমন্বয় করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘গরমের কারণে আকার পরিবর্তন হওয়াই লোহার ধর্ম। বিষয়টি মাথায় রেখেই নকশার সময় দুটি রেলের পাতের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখা হয়। ফাঁকা জায়গাটি জোড়া দেয়া হয় ‘ফিশপ্লেট’ দিয়ে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো এ ফিশপ্লেটে নির্দিষ্ট সময় পরপর বিশেষ গ্রেডের লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করা। পাশাপাশি ফিসপ্লেটটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে রাখা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে রেলপথে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে, অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে, রেলপথ বানানো হচ্ছে, ইঞ্জিন কোচ কেনা হচ্ছে, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের যে কাজটি সবচেয়ে জরুরি, সেটাই ঠিকমতো হচ্ছে না।’
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের পাশাপাশি রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর না রাখলে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ রেল ব্যবহার করলে ট্রেন চলাচল করতে গিয়েও লাইন বেঁকে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বাড়তি তাপমাত্রার মধ্যে রেলপথ বেঁকে যাওয়ার ঘটনা প্রতিরোধে রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, মেয়াদোত্তীর্ণ রেল প্রতিস্থাপন, রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর রাখার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের রঙ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেক দেশেই রেলে এক ধরনের সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। এর ফলে রেলের তাপ সহনীয়তা বেড়ে যায়। স্বাভাবিকের চেয়ে রেলের তাপমাত্রা ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়ে দেয় এ বিশেষ রঙ।’
উষ্ণায়িত বিশ্বে বিভিন্ন দেশে রেলকর্তাদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রেলপথের তাপ সংবেদনশীল আচরণ। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নানা ধরনের আলোচনা-গবেষণাও হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ রেলওয়ের এ-সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ এখনো সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণেও থেকে যাচ্ছে ঘাটতি। এজন্য প্রধানত জনবল সংকটকে দায়ী করছেন রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ