চরম উষ্ণতার কারণে মানুষের মধ্যে অসুস্থতা ও মৃত্যু বাড়ছে, যার ফলে মানুষের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরগুলোয় জনসংখ্যাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে শহরগুলোয় তাপমাত্রাও চরমভাবে বাড়ছে। আর এই চরম উষ্ণতার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরের তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়ান্স সেন্টারের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে ঢাকাসহ বিশ্বের ১২টি শহরে চরম তাপের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রা-আর্দ্রতার কারণে ঢাকা প্রতিবছর প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, যা ঢাকার বার্ষিক শ্রম উৎপাদনের ৮ শতাংশের বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চতাপের কারণে অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা কমাতে উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতি ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
ঢাকা ছাড়া বাকি ১১টি শহর হলো—এথেন্স (গ্রিস), ব্যাংকক (থাইল্যান্ড), বুয়েন্স এইরেস (আর্জেন্টিনা), ফ্রিটাউন (সিয়েরা লিওন), লন্ডন (যুক্তরাজ্য), লস অ্যাঞ্জেলস (যুক্তরাষ্ট্র), মিয়ামি (যুক্তরাষ্ট্র), মন্টেরেই (মেক্সিকো), নয়াদিল্লি (ভারত), সান্তিয়াগো (চিলি) ও সিডনি (অস্ট্রেলিয়া)। ১২টি শহরে ২০২০ সালে গড় ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তাপমাত্রা কমাতে ব্যবস্থা না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার হতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ এলাকা ইতিমধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা-আর্দ্রতার আওতায় এসে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার তাপ তার নগরকেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত। তার মধ্যে কিছু অনানুষ্ঠানিক বসতি এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় জনঘনত্ব বেশি। অন্যদিকে সবুজ পরিসরের অভাব রয়েছে। ঢাকায় এ ধরনের এলাকা বাড়ছে। শহরের এই এলাকাগুলোর তাপমাত্রা পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।
এই তাপ দরিদ্রদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক, পরিবহন এবং খুচরা বাণিজ্যের মতো খাতে, যেখানে মজুরি গড়ের চেয়ে কম, সেখানে ক্ষতির পরিমাণ ইতোমধ্যে আয়ের প্রায় ১০ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরি পোশাক বা ইট তৈরির মতো খাতে উৎপাদনে ক্ষতি বিশেষভাবে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব জায়গায় যন্ত্রপাতি বা ওভেনের সান্নিধ্যে শ্রমিকদের অধিক তাপমাত্রার সম্মুখীন হতে হয়।
উচ্চ তাপমাত্রা-আর্দ্রতার কারণে ঢাকা প্রতিবছর প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, যা ঢাকার বার্ষিক শ্রম উৎপাদনের ৮ শতাংশের বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বসতির ঘনত্ব অনেক বেশি। এই এলাকায় তাপমাত্রা সাধারণত ঢাকার আশেপাশের তুলনায় ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে।
এই ধরনের তাপমাত্রা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ‘পৃথিবী জ্বলছে। দুর্ভাগ্যবশত, এটি অত্যুক্তি নয়। জলবায়ুর কারণে সৃষ্ট তাপ আমাদের জীবনযাপন ও কাজ করার পদ্ধতি পরিবর্তন করছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় শ্রমনিবিড় অর্থনৈতিক তৎপরতা বেশি। তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা এখানে কম। ফলে ঢাকা উচ্চতাপের প্রভাবের জন্য অস্বাভাবিক ঝুঁকিপূর্ণ। নিম্ন আয়ের কর্মীরা বিশেষভাবে উচ্চতাপের সংস্পর্শে আসে। তারা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়। অনিয়ন্ত্রিত উষ্ণায়নের কারণে তৈরি পোশাক, পরিবহন ও খুচরা ব্যবসা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ হকার রয়েছেন। যাদের বড় অংশ গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। শ্রমিক হিসেবে তাদের দক্ষতা কম। বেশির ভাগ হকারের কোনো স্থায়ী দোকান নেই। তারা মূলত ফুটপাতে উন্মুক্ত স্থানে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করেন।
জরিপমতে, তাপপ্রবাহ চলার সময় ৯ শতাংশ হকার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ আয় হারান। আর প্রায় ২৫ শতাংশ হকার ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ আয় হারান।
মনুষ্য সৃষ্ট উদ্ভাবনের কারণে বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। গ্রামের তুলনায় শহরকেন্দ্রিক এই তাপমাত্রা বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্প-কারখানা সৃষ্ট বর্জ্য পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এর সঙ্গে খাপখাইয়ে চলা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। তাপমাত্রার ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে মানুষের শরীর থেকে বাড়তি ঘাম ঝরছে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানও বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের পথ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধ করা এবং মানুষের বাড়তি খনিজ উপাদান গ্রহণ করা।
তারা বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মানুষের যে কর্মক্ষমতা কমছে, এর থেকে উত্তরণের একটাই পথ তাপমাত্রা কমানো। আমাদের শিল্প-কারখানাগুলোর পণ্য উৎপাদনের যে প্রক্রিয়া, তা খুবই অনিয়মতান্ত্রিক। ফলে তাদের ক্ষতিকর বর্জ্যরে ফলে এক একটি শহর উত্তপ্ত নগরীতে পরিণত হচ্ছে। এর থেকে বাঁচার একটাই পথ পানির মাত্রা কতটুকু থাকবে, গ্রিন কতটুকু থাকবে এবং ভূমির পরিমাণ কতটুকু থাকবে, তা নির্ধারণ করা। যদি এটা করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা আরো কমবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৬
আপনার মতামত জানানঃ