ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানি গ্রুপের দুটি ইউনিটে ১৫০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী ২৫ বছর মেয়াদে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা বা ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ নেবে। এ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশি নাগরিক সমাজের জোট বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) ও ভারতীয় গ্রোথওয়াচের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও ভারত থেকে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ভারতের পাঁচটি উৎস থেকে বর্তমানে বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। যদিও চাহিদা না থাকায় আমদানি সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। এরপরও ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আমদানি করা হবে আরও এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে এ বিদ্যুৎ আমদানিতে ২০১৭ সালে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এ বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশকে উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে, বছরে যার পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। যদিও বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত রয়েছে। তাই এ বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে অনেকটাই অস্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির এ বিদ্যুৎ আমদানির কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে শীতে এ চাহিদা সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। আবার সন্ধ্যার তুলনায় দিনে চাহিদা অনেকখানি কমে যায়। তাই উচ্চ ব্যয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত পুরোই অযৌক্তিক। এছাড়া এ বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ও অনেক বেশি পড়বে বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এদিকে, বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগামী আগস্ট মাসে উৎপাদন শুরু করবে, যদিও সঞ্চালন লাইন নির্মিত না হওয়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলেও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক ইউনিট বিদ্যুৎ না নিয়েই আদানি গ্রুপকে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া দিতে হবে।
এ সম্পর্কে প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, ‘যে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া দেওয়া হবে তার পরিমাণ কর্ণফুলী টানেলের মোট বাজেটের নয়গুণ এবং ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের চারগুণেরও বেশি।’
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে যে পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ কেনা হয়Ñএকই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হবে। কেন্দ্রভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ হলো, যদি বিদ্যুৎ না নেওয়া হয় বা বিদ্যুতের প্রয়োজন যদি না হয় তাহলে ইউনিটপ্রতি একটি নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়া হয়। বিলিয়ন ডলারের বেশি যেখানে বিনিয়োগ হবে, সেই বিনিয়োগের নিরাপত্তা সারা দুনিয়াতে দেওয়া হয়, এটা নতুন কোনো ফর্মুলা নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতের ঝাড়খন্ডে। সেখান থেকে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসবে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন তারিখ (সিওডি) এখনো ঠিক করা হয়নি। সিওডি ঠিক করবে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সিওডি হওয়ার আগে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এই পর্যায়ে পাওয়া বিদ্যুতের অর্থ দেওয়া লাগে না। যতক্ষণ সিওডি না হবে ততক্ষণ এক পয়সা বিদ্যুতের দাম দেবে না পিডিবি, ক্যাপাসিটি চার্জ এ সময় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘এ ধরনের গবেষণা দেশবিরোধী অপপ্রচার, যড়যন্ত্রমূলক এবং গোটাটাই দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যার ওপর। বাংলাদেশে কারা এসব করছে তা খতিয়ে দেখা হবে।’
বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপ প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বা ৪২৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি কেন্দ্রভাড়া নেবে। এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জনগণের উপকার না করে বরং আদানি গ্রুপকে আরও ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি পাওয়ারের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে কমপক্ষে ৯ টাকা ৯ পয়সা; যা বিদ্যমান আমদানিকৃত বিদ্যুতের মূল্যের তুলনায় ৫৬ শতাংশ ও ভারতের সৌরবিদ্যুতের তুলনায় ১৯৬ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া, আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর কমপক্ষে ৫.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। অন্যদিকে দেশে ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে।
বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, ‘এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করবে। বাংলাদেশের অতি-সক্ষমতার মাত্রা ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ভারত থেকে অতি-খরুচে বিদ্যুৎ আমদানির কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
৭৪৮ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিটে মোট ১৪৯৬ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডের গড্ডা জেলায়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনতে ২৪৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হবে। এর ৯৫ কিলোমিটার ভারতের অংশে, বাকিটা বাংলাদেশে। ভারতের অংশে যে লাইন নির্মিত হবে, তার ব্যয়ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী, গড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত ক্ষতিকর বায়ুদূষণ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির (স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও মৎস্য) পরিমাণ বছরে ৫ হাজার ৫৬৯ কোটি ভারতীয় রুপি (৭২৯.৬৪ মিলিয়ন ডলার) ও ২৫ বছরের মেয়াদে কমপক্ষে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭০৮ কোটি ভারতীয় রুপির (২৪.৭২ বিলিয়ন ডলার) সমান। আদানি পাওয়ার পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির কোনো দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় পিডিবি ২০১৭ সালের নভেম্বরে আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি (পিপিএ) করে। এ পিপিএ অনুসারে পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিপরীতে আদানি গ্রুপকে ৩ টাকা ২৬ পয়সা (০.০৩৮ ডলার) কেন্দ্রভাড়া দেবে যা বাংলাদেশের অন্য যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে বলা হয়, এই শিল্প গ্রুপ ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় অধিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ১ হাজার ২৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে। তারা সন্ত্রাসী ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্ছেদ ও অত্যাচার করছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে কী পরিমাণ পরিবেশদূষণ হবে সে হিসাব দিয়ে বলা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি বছর ৯৩ দশমিক ৫ লাখ টন কার্বন নির্গমন হবে, যা ২৫ বছরের মেয়াদকালে ২২ কোটি ১১ লাখ টনে পৌঁছে যেতে পারে। ভারত বর্তমানে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে পৃথিবীর পঞ্চম ও কার্বন নির্গমনের দিক দিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র দূষণ ও নির্গমনের দিক দিয়ে ভারতের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে।
গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত গ্লাসগো সম্মেলনে ভারত ২০৫০-এর বদলে ২০৭০ সালে গড়শূন্য নির্গমনের ঘোষণা দিলে সারা পৃথিবী থেকে এ অবস্থানের সমালোচনা করা হয়। আদানি পাওয়ারের গড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতকে ‘জলবায়ুবিরোধী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও গ্রোথওয়াচের সমন্বয়কারী বিদ্যা দিনকর বলেন, ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা অনুসারে ভারত বা অন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ করে শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানি আমদানির জন্য বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়া উচিত।’
বিডব্লিউজিইডি’র আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের চুক্তি বাতিল করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ