ইতিহাসবিদ নরম্যান নেইমার্ক তার নতুন বইতে নতুন তর্কের সূত্রপাত করেছেন। তিনি গণহত্যার সংজ্ঞা পাল্টে তার মধ্যে প্রতিটা দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। কারণ গণহত্যা এখন অনেক দেশের সরকারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দশকে রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, দারফুর ও বসনিয়ায় গণহত্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
জাতীয় পর্যায়ে হত্যাও গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। গণহত্যা শব্দটার আলাদা শক্তি আছে। আন্তর্জাতিক আদালতে, একে ‘ক্রাইম অব ক্রাইমস’ বলা হয়।
গণহত্যা শব্দটা প্রথম সংজ্ঞায়িত হয় ১৯৪৮ সালে। জাতিসংঘের এক সম্মেলনে। যে সম্মেলন ছিল হলোকাস্টের উপর। তাই নেইমার্কের মতে গণহত্যার সংজ্ঞায় প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্র বিবেচনা করা হয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ সভা ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ তারিখে ‘গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য চুক্তি’-র প্রস্তাব গ্রহণ করে। বিশটি রাষ্ট্র তা রেটিফাই করার পর ১২ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে এটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারা যুদ্ধাবস্থায় ‘গণহত্যা’র বিচার করলেও শান্তির সময় বা যখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে না তখন যদি গণহত্যা’ হয় তাকে আমলে নেন নি। সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে যুদ্ধ লেগে যাবার পর যে অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়েছে কেবল তারা তাকেই আমলে নিয়েছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শান্তিকালীন সময়ে ‘গণহত্যা’-র বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
১৯৪৬ সালে কিউবা, পানামা এবং ইন্ডিয়া একটি খসড়া প্রস্তাব জাতিসংঘে পেশ করে। এর উদ্দেশ্য ছিল এই সত্য প্রতিষ্ঠা যে যুদ্ধের সময় ছাড়াও শান্তির সময়; অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধবিগ্রহ নাই, শান্তি বজায় আছে, এমন পরিস্থিতিতেও ‘গণহত্যা’ হতে পারে। সেই অপরাধ প্রতিরোধ যেমন করা দরকার তেমনি অপরাধীর শাস্তি বিধানও দরকার। এটাও জানান দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল যে এই ধরণের অপরাধ সার্বজনীন আইনী এক্তিয়ারের অধীন।
জাতিসংঘ ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে ৯৬(১) প্রস্তাব পাশ করে। এতে ঘোষণা দেওয়া হয় “গণহত্যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি অপরাধ যা প্রতিটি সভ্য দেশ নিন্দা করে”।
সেখানে এই অপরাধ শান্তির সময়ে নাকি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে হয়েছে সেই বিষয়ে কিছু বলা হয় নি। অর্থাৎ দুই অবস্থাতেই এই ধরণের অপরাধ সংঘটিত করা নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
নেইমার্ক তার বইতে স্ট্যালিনের গণহত্যা প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এটা নিয়ে আরও বড় পরিসরে আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯৩০ সালের শুরুতে স্ট্যালিন তার নিজ দেশের প্রায় এক মিলিয়ন নাগরিককে হত্যা করে। পাশাপাশি কয়েক মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক শ্রমিকে পরিণত হয়, নির্বাসিত হয়, দুর্ভিক্ষে মারা যায়।
স্ট্যালিনের শাসনামলে ভুল জায়গায় একটি ভুল কথাও দরজায় ডেকে নিয়ে আসতে পারতো রাশিয়ার বিশেষ পুলিশ দলকে, যারা সোভিয়েত গুলাগে আপনাকে টেনে নিয়ে যেতে সর্বদা প্রস্তুত, যেখানে মৃত্যুর ডাক না আসা পর্যন্ত আপনাকে কাজ করে যেতে হবে!
স্ট্যালিনের সময়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন লোককে গুলাগে বন্দী করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক বন্দী, কেউবা সাধারণ জনগণ; যারা সোভিয়েত শাসন সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেছে। নেইমার্কের মতে, এই সমস্তকিছু গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। এই সূত্র বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শাসনামলে গত এক দশকে ঘটা সমস্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যা বাড়ছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে। নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্বের কারণেও ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঘটছে গুপ্ত হত্যা। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন না কোনভাবে আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মীরা জড়িত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে রাজধানীতে ৩ হাজার ৩৭৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বছরে গড়ে ২৫০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ সময়ে।
আবার পুলিশ সদর দফতরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ১৫ হাজার ৩০৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে প্রতিবছর ৩ হাজার ৮২৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটে।
অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৭৬টি। এ হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে।
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমলেও ২০২১ সালে তা আবার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওই বছর ১৫৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পূর্ববর্তী চার বছরের গড় সংখ্যার তিনগুণেরও বেশি।
ডিএমপির এক তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২৭ দিনে রাজধানীতে ৩৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২ জন ও মার্চ মাসের প্রথম ২৭ দিনে ১৩ জন খুন হয়। এর মধ্যে কতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সেটির হিসাব নেই।
তবে আসকের তথ্যে দেখা গেছে, এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। শুধু জানুয়ারিতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২৯টি। ২০২১ সালে প্রতিমাসে এই হত্যাকাণ্ডের গড় সংখ্যা ছিল ১৩। এ হিসাবে গত জানুয়ারিতে তিনগুণ বেড়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
এদিকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুলিশ সদর দফতরের ওয়েবসাইটে অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া হতো। ২০১৯ সালে আংশিক তথ্য দেওয়া হলেও এর পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এতে কী পরিমাণ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং কতগুলোর বিচার সম্পন্ন হয়েছে সে তথ্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
এতে অপরাধের প্রকৃত চিত্রও জানা সম্ভব হচ্ছে না। একে এক ধরনের ‘লুকোচুরি’ বলছেন অনেকে। তবে এটি লুকোচুরি নয় দাবি করে তথ্য অধিকার আইনে নিয়ম মেনে আবেদন করলে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশযোগ্য সব তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
আসকের হিসেব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার বছরেই রাজনৈতিক সহিংসতায় সারাদেশে নিহত হয় ৪২ জন। ২০১০ সালে ৭৬ জন। ২০১১ সালে কমে ৫৮ জন হলেও ২০১২ সালে ৮৪ জন নিহত হয়। তবে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় পরের বছর ২০১৩ সালে। বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৭ জনে। এরপর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪৭ জন।
অপরদিকে চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরেও (২০০১-২০০৬) নিহতের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা ও বন্দুকযুদ্ধের নামে নিহতের ঘটনা সাত শতাধিক। এর মধ্যে ২০০৬ সালেই নিহত হয় ১২০ জন।চারদলীয় জোটের শাসনামলে ২০০২ সালে ৩২০ জন, ২০০৩ সালে ২০৩ জন, ২০০৪ সালে ৫২ জন ও ২০০৫ সালে ৩৪ জন নিহত হয়।
তবে রাজনৈতিক সহিংসতায় সবচেয়ে কম নিহত হয় তত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে (২০০৭-০৮)। এ সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১১ জন নিহত হয়েছে। ২০০৭ সালে ৭ জন এবং ২০০৮ সালে ৪ জন নিহত হয়েছে ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ইতিহাস অনেক পুরনো। এখন জনগণকে রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীই পেয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীর তকমা। তবে এই সব হত্যার পেছনে যে ক্ষমতাসীনদের হাত আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪০০২ জন মানুষ।
এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ২ হাজার ১৬৩ জন পুলিশের হাতে এবং ১২শ ২৪ জন র্যাবের হাতে নিহত হয়।
অধিকার নামে সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে যে অভিযান চালানো হয়েছিল তাতে ৩৯ জন নিহত হয়েছিল। তবে তৎকালীন সরকার এ ঘটনাগুলোর দায়মুক্তি দিয়েছিল।
আর নিহত বাকিদের মধ্যে অনেকে অন্য বাহিনী কিংবা একাধিক বাহিনীর যৌথ অভিযানে নিহত হয়। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে শুধু নারায়ণগঞ্জে র্যাবের হাতে ৭জন খুনের ঘটনায় বিচারিক আদালতে বিচার হয়েছিল।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম সাত মাসে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২০৭টি। এর মধ্যে গ্রেফতারের আগে ক্রসফায়ারে ১৪৫ জন এবং গ্রেফতারের পরে ক্রসফায়ারে ৩৭ জন নিহত হয়।
সংস্থাটির সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নিনা গোস্বামী বলেন, কোন ধরণের জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই এ ধরণের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না। তার মতে, মাদক চোরাচালান রোধের অজুহাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে দিনের পর দিন চালানো হলেও আসলে সেটি রোধ করা যায়নি।
অনেকের ধারণা যে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মেরেছে হত্যার মাত্রা ও হত্যার ধরণ সেই পর্যায়ের না হলে তাকে ‘গণহত্যা’ বলা যাবে না। হিটলারের ইহুদি নিধন নিঃসন্দেহে একটি বর্বর ও ভয়ানক অপরাধ। এই নিধনযজ্ঞ এখন এমন একটা মিথে পরিণত হয়েছে যাতে অনেকের ধারণা একই মাত্রার বা একই ধরণের হত্যাকাণ্ড না হলে তাকে গণহত্যা বলা যাবে না। যেমন, গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে না মারলে সেটা গণহত্যা নয়। বা হত্যার সংখ্যা কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে না গেলে তাকেও গণহত্যা বলা যাবে না। এই ধারণা ভুল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকার না করার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০১
আপনার মতামত জানানঃ