ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী লেখম মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ এ আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির এবং অপব্যহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসবের মধ্যেই প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
এ আইনে প্রতি মাসে গড়ে ৩৪টি মামলায় ৮৬ জনের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক আলী রীয়াজ। আজ শনিবার(২৩ এপ্রিল) সকালে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘অন্তহীন দুঃস্বপ্ন-বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে মুখ্য আলোচকের আলোচনায় তিনি এই তথ্য জানান।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক আলী রীয়াজ। তিনি জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ২৪৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৪২ জনকে আটক করা হয়। ওয়েবিনারে আলোচকেরা মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও পরিধি হরণকারী এবং বিতর্কিত এসব আইন প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছেন।
আলী রীয়াজ বলেন, প্রতি মাসে গড়ে ৩৪টি মামলায় ৮৬ জনের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ জামিন পেলেও অনেকেই এখনো জামিন পাননি। তথ্য না পাওয়ায় কতজন আটক আছে, তা-ও জানা সম্ভব হচ্ছে না।
লেখক আলী রীয়াজ বলেন, ‘এই আইনে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হচ্ছেন। ৮২০ জনের পেশার তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ রাজনীতিবিদ ও ২৫ শতাংশ সাংবাদিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে এই আইনের শিকার হচ্ছেন ছাত্র ও ব্যবসায়ীরা। এই আইনে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত ১৯ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এই আইনে ১০৮টি মামলায় ২০৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ১০৮টি মামলা করেছেন ৯৬ জন অর্থাৎ একই ব্যক্তি একাধিক মামলা করেছেন। অভিযুক্ত এবং আটক ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি। রাজধানীর বাইরে যারা সাংবাদিকতা করছেন, এই আইন তাঁদের জন্য একটি বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এসব মামলা প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, যারা এই মামলাগুলো করছেন, তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় রাজনীতিবিদের সংখ্যাই বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা মোট ১৫৪টি মামলা করেছেন। এগুলো কোনো না কোনোভাবে সরকারের অনুমোদন বা ইঙ্গিত পেয়েই করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এ ছাড়া সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যক্তিগত মামলা হয়েছে ২০৬টি।
ওয়েবিনারে আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্টিকেল ১৯-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘একটি বিশেষ মতাদর্শের মানুষকে রক্ষা করার জন্য কোনো আইন হতে পারে না। ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ে যে আইনটি হচ্ছে, তা নিয়েও আমরা খুবই চিন্তিত। এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) থেকেও ভয়ংকর। আমাদের সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেসব বিচারককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের সাইবার সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। ডিএসএ মামলায় জেলে মানুষ মারা গেছে, অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। নির্বাচন আসছে, ভবিষ্যতে ডিএসএর ব্যবহার কত ব্যাপক হবে, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
এই আইনে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হচ্ছেন।
আইসিটি আইনে যে সমস্যাগুলো ছিল ডিএসএতেও সেই সমস্যাগুলো রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। তিনি বলেন, ‘এখন আবার আরেকটি আইন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বলতে কী বোঝায়? রাষ্ট্র এবং সরকার কিন্তু এক বিষয় না। আগে রাজা-বাদশা যারা ছিল তারাই ছিল রাষ্ট্র-সরকার। কিন্তু স্বাধীন দেশ হওয়ার পর মানুষের চিন্তায় রাষ্ট্র-সরকারের ধারণা আলাদা হলেও আমাদের দেশে তা আসলে কতটুকু হয়েছে, তা ভেবে দেখা দরকার। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলতে কী? কারও অনুভূতি যদি ঠুনকো হয়ে থাকে? কার অনুভূতি? এ রকম ব্লাসফেমি অফেন্স আমরা রাখতে চাই কি না? আধুনিক রাষ্ট্রে এমন ব্লাসফেমি আইন আছে কি? এসব প্রশ্নের সমাধান জরুরি। সবচেয়ে জরুরি হলো, ডেটা প্রটেকশন। আমার তথ্যের মালিক যদি আমি হই তাহলে সরকার কেন আমার তথ্য নিয়ে যাবে? চুনকাম করে, মেকআপ করে ভাবমূর্তি রক্ষা করে লাভ নেই। নিজের ভেতরে ঠিক করতে হবে। জনগণ হচ্ছে মালিক। তার তথ্য তার সম্পত্তি। তার তথ্য, সম্পত্তি রক্ষা করাই রাষ্ট্রের কাজ।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের হাতে কড়া পরিয়ে শৃঙ্খলিত করার একটা প্রচেষ্টা চলছে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কতগুলো আইন করে জনগণের অধিকার রক্ষা করার বদলে আরও ক্ষুণ্ণ করছে। এই আইনগুলো এখন অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এসব অস্ত্র যখন যার বিরুদ্ধে প্রয়োজন সেখানে প্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতাসীন ও তাদের অনুগতরা শুধু আইন দিয়ে না, তারা নিজেরাও নানান অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু এই অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যে আইনগুলো হচ্ছে, এসবের কোনোটাই জনগণের স্বার্থে নয়, এগুলো ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে। এগুলো প্রতিরোধ করা না গেলে আমাদের জীবযাপন আরও দুঃসহ হবে।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বলেন, ‘আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা নানাভাবে খর্ব হচ্ছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা কী মানুষের আছে? রাজনৈতিক দলের নেতারাই যদি কথা বলতে না পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কথা বলবে কীভাবে? ডিএসএর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মুক্তভাবে তথ্য, কথা আদান-প্রদানের যে জায়গা ছিল, তা সংকুচিত হয়ে গেছে। আমি নতুন বই লিখতে এখন ভয় পাই। এখন আরও একটি আইন হচ্ছে। সামনে নির্বাচন, নির্বাচনের আগে এসব আইন করে গণতান্ত্রিক সরকারের খুব বেশি সুবিধা হবে না।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে— এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০২
আপনার মতামত জানানঃ