আগামী ১৮-২০ মে ব্রাসেলসে ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের ১০ম সেশন। সেখানে নির্বাচন ও বিচার ব্যবস্থা সংস্কার, সুশাসন, মানবাধিকার, শ্রমিক নিরাপত্তা অধিকারসহ বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হতে চলেছে।
বর্তমানে ইইউ- এর বাজারে বাংলাদেশে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। তবে এ নীতি ২০২৪ সালে সংশোধিত হয়ে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে।
আর তাই ২০২৪ সালের পরও ২৭ জাতির এ জোটে যাতে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকে, সেজন্য যথাযথ উত্তর তৈরি করছে ঢাকা। কারণ গণতন্ত্র, সুশাসন ও বিভিন্ন অধিকার প্রসঙ্গে ইউরোপিয় ইউনিয়নের বেশকিছু জিজ্ঞাসা রয়েছে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ ইইউ বাজার থেকে আসে; কারণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া সব বাংলাদেশি পণ্য সেখানে শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার ভোগ করে।
তবে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ২০২৪ সাল থেকে এ সুবিধা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে, ওই বছর ইইউ তাদের নতুন জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস) নীতি চালু করবে।
নতুন নীতির অধীনে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে ইইউ ২০১৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশকে একটি ৯ দফা কর্মপরিকল্পনা (অ্যাকশন প্ল্যান) শর্ত হিসেবে দেয় এবং এটি বাস্তবায়নের সময় নির্ভর একটি রোডম্যাপ চেয়েছিল।
সেখানেই প্রথমবারের মতো মানবাধিকারের বিষয়টিকে ৯ দফা কর্মপরিকল্পনার একটি উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে শিশুশ্রম নির্মূল, সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) অধিভুক্ত কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালু করার মতো “সংবেদনশীল” বিষয়গুলিও ছিল।
এক বছর পর বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে ৯-দফা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ জমা দেয়। রোডম্যাপের বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে, ইইউর ইবিএ পর্যালোচনা কমিটি গত মাসে বাংলাদেশ সফর করে।
এছাড়াও, ২০২৩ সালে বিদ্যমান ইবিএ’র মেয়াদ শেষ হবে। তাই ২০২৪ সাল থেকে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা ও উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর ২০২৯ সাল থেকে ইইউভূক্ত দেশগুলোতে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ।
মানবাধিকার পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেবে ইইউ
এক্ষেত্রে ইইউ মানবাধিকার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে সমর্থনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নাম না প্রকাশের শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইউরোপিয় ইউনিয়ন কম্বোডিয়া এবং মিয়ানমারের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলেও; জোটটি কখনোই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ইবিএ বা জিএসপি স্কিমের সঙ্গে যুক্ত করেনি। তবে ইইউ গত দুই বছর ধরে এই ইস্যুতে মনোযোগ দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেবে।
তারা আরো বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইইউ-ও পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থানের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন চাইতে পারে।
সুশাসন ও মানবাধিকার বিষয়ক সাব-গ্রুপের খসড়া এজেন্ডা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এতে গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সুশীল সমাজের কার্যক্রমের মতো বিষয়গুলিকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। একইসাথে, জাতিসংঘে মানবাধিকার ইস্যুতে সহযোগিতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারও বৈঠকে আলোচনার প্রধান বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে।
নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, মৃত্যুদণ্ড বাতিল, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ও তাদের প্রত্যাবাসনও বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে।
কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?
ইইউ-বাংলাদেশ আলোচনা এজন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা সামনে রেখে এরমধ্যেই মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো নানাবিধ বিষয়ে নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা ও নীতি প্রণয়নের প্রস্তুতি শুরু করেছে ঢাকা।
এজন্য আগামী ১৭ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সভায় বসছেন লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির। তার আগেই মন্ত্রণালয়গুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের নীতি ও অবস্থান সম্পর্কিত লিখিত বক্তব্য চেয়েছে লেজিসলেটিভ বিভাগ।
এর আগে গত মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্ব সংলাপে বাংলাদেশকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সরকারি অবস্থানের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নের জবাবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্নয়নের লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্ব-সহকারে তুলে ধরে ঢাকা। গুরুত্ব দিয়ে আরো দেওয়া হয়, নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত ‘সেভেন মার্ডার’ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তারের মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষায় র্যাবের ভূমিকার উদাহরণ।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর শ্রম অধিকার রক্ষায়, সরকার যে বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে তাও তুলে ধরে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আসন্ন ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের বৈঠকেও সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবে।
এই যৌথ কমিশনটি ২০০১ সালের সহযোগিতা চুক্তির অধীনে ইইউ এবং বাংলাদেশের গৃহীত প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর আগে, ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর যৌথ কমিশনের ৯ম অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
যৌথ কমিশনের বৈঠকের আগে অনুষ্ঠিত হবে: মানবাধিকার ও সুশাসন; বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক তিনটি উপ-গ্রুপের সভা।
সূত্র মতে, যৌথ কমিশন সভায় বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব। লেজিসলেটিভ বিভাগের সচিব মানবাধিকার ও সুশাসন উপ-গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। বাণিজ্য সচিব বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উপ-গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন এবং উন্নয়ন সহযোগিতা সাব-গ্রুপের সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব।
ইআরডি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে, তাদের প্রত্যেককে ব্রাসেলসের বৈঠকে যোগদানের জন্য দুজন কর্মকর্তাকে মনোনীত করতে বলেছে; যাদের একজনকে অবশ্যই সচিব বা অতিরিক্ত সচিব এবং অন্যজনকে একজন যুগ্মসচিব বা উপসচিব হতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ