বহু বছরের প্রতীক্ষা ও অনিশ্চয়তার পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়েছে বাংলাদেশের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য যুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতে। এটি হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য এক ঐতিহাসিক সূচনা।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এই চুক্তি। এমন একটি চুক্তি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের জন্য শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চার হতে পারে বলে মনে করছেন অংশীজনরা৷ ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৯৭% পণ্যে শুল্ক মুক্ত সুবিধা পেয়েছে।
যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না৷ প্রায় ১৫.৫০% শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে দেশটিতে৷ আর এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর।
বিষয়ে গত মাসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন। যেখানে বাণিজ্য সচিবও ছিলেন। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তাব করে ঢাকা। এতে সম্মতি দিয়ে বাংলাদেশের কাছে চুক্তির খসরা চেয়েছেন ইউএসটিআর এর কর্মকর্তারা।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে দেশের মোট রপ্তানি ১৭.০৯% এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮% এর বেশি যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট উভেন (Woven) পোশাকে প্রায় ২৬% নিট ওয়্যারের ১১.৭১% এবং হোম টেক্সটাইল পণ্যের ১৬.১২% যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে কাচা তুলা ও স্ক্র্যাট লোহা। আর এ দু’টি পণ্যে শুল্ক হার যথাক্রমে ০% ও ১%।
প্রসঙ্গত, এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাবটি আসে গতমাসে, যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং ইউএসটিআর চুক্তির খসড়া চেয়েছে। বাণিজ্য সচিব জানিয়েছেন, বাংলাদেশ আগে কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রকে এফটিএ প্রস্তাব করলেও তখন তারা আগ্রহ দেখায়নি, কিন্তু এবার তা রাজী হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক, যার মাধ্যমে দেশে মোট রপ্তানির ১৭.০৯ শতাংশ এবং পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশ আয় হয়। দেশের পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এফটিএ স্বাক্ষর হলে, বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বাড়বে। বর্তমানে, ভিয়েতনাম এবং ভারত ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এফটিএ চুক্তি প্রস্তাব করেছে, ফলে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে।
বর্তমানে, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে, যেখানে ভিয়েতনাম পাচ্ছে মাত্র ৭ শতাংশ শুল্ক। এফটিএ কার্যকর হলে, শুল্কহীন সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের রপ্তানি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
২০১৩ সালের আগে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯৭ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে, তৈরি পোশাকের জন্য ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছিল, যা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এফটিএ স্বাক্ষর করার বিষয়টি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, রাজনৈতিকভাবেও তা প্রভাব ফেলবে। ড. মোস্তফা আবিদ খান, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য, বলেছেন, “এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে এটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের লাভজনক সুযোগ হবে। তবে, এর জন্য বাংলাদেশকে মেধাস্বত্ব, শ্রম মানদণ্ড, পরিবেশগত বিধিমালা ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু সংশোধনী করতে হবে।”
বর্তমানে, বাংলাদেশ বেশ কিছু দেশের সাথে এফটিএ চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে, তবে চীন, ভারত এবং অন্যান্য কিছু দেশের সাথে এই আলোচনাগুলো এখনও ফলপ্রসূ হয়নি। তবে, সরকারের কাছে এফটিএ চুক্তির ব্যাপারে স্বার্থপর নীতির মাধ্যমে শক্তিশালী এবং বৈষম্যমুক্ত বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ