সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে পশ্চিম তীরে ১৪ বছরের কিশোরসহ মারা গেছে পাঁচ ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলে একাধিক প্রাণঘাতী হামলার পর পশ্চিম তীরে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে তারা নিহত হন। খবর আল-জাজিরার।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার(১৪ এপ্রিল) দিনের শুরুতে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হন। গতকাল বুধবার অপর তিন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়।
গতকাল সন্ধ্যায় ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তাদের দাবি, সেনাদের লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে ওই কিশোর। তখন ‘আসন্ন হুমকি মোকাবিলায়’ সেনারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে।
অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের প্রতিবাদে বুধবার রাস্তায় নেমে আসেন ফিলিস্তিনিরা। বিক্ষুব্ধরা এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল ও পেট্রোল বোমা ছোড়ে বলে জানায় গণমাধ্যম।
ইসরায়েলের দমন-পীড়নমূলক অভিযানের প্রতিবাদ জানিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চড়াও হয় ফিলিস্তিনিরা। অভিযানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের দফায় সংঘর্ষ হয়। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনাদের সাঁজোয়া যান লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ছে ফিলিস্তিনিরা। এ সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলির শব্দও শোনা যায়।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বুধবার ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান ৩৪ বছর বয়সী আইনজীবী মোহাম্মদ হাসসান মোহাম্মদ আসসাফ।
আইনজীবী হিসেবে আসসাফ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারত্বের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) হয়ে কাজ করতেন।
এ ছাড়া ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ বছর ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৩৬ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে যেসব ফিলিস্তিনি ইসরায়েলে হামলা চালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, তারাও রয়েছে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গতকাল রামাল্লার কাছে ইসরায়েল বাহিনী এক গ্রেপ্তার অভিযান চালালে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় এক ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাৎক্ষণিক এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বা পুলিশ। ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি সাঁজোয়া যানগুলোতে একদল ফিলিস্তিনি পাথর নিক্ষেপ করছিল। থেমে থেমে গুলির শব্দও শোনা যায়।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত জানিয়েছে, অভিযানে তিন ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ইসরায়েলিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। সামরিক বাহিনী ও পুলিশের বিবৃতি অনুযায়ী, গতকালের অভিযানে ‘সন্ত্রাসী’ সন্দেহে ২০ জনকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে মার্চ থেকে ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ তেলআবিবে হামলায় ইসরায়েলি হতাহতের ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট সব নিরাপত্তা বাহিনীকে হামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেছেন।
এরই মধ্যে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে পশ্চিম তীরে ১৪ বছরের কিশোরসহ মারা গেছে পাঁচ ফিলিস্তিনি।
সম্প্রতি তেলআবিবের বিনোদন এলাকায় এক ফিলিস্তিনির হামলায় তিন ইসরায়েলি নিহত এবং ১৬ জন আহত হওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়।
ইসরায়েলি পুলিশ জানিয়েছে, সেদিন রাতে জনাকীর্ণ বার ও রেস্টুরেন্টগুলোয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলাকারী ফিলিস্তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় এরই মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে আটকের বিষয়টি জানিয়েছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ। তিনি বলেন, প্রয়োজনে হাজারও লোককে আটক করা হবে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী পশ্চিম তীরের উত্তর দিকে প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। এ ছাড়া এক হাজার ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য তেলআবিবে অভিযান পরিচালনা করছে।
মোট আহত ১৬ জনের মধ্যে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আটজন। এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। বাকি আহত আটজনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে তেলআবিবে হামলাকারী হাজেমের বাবা ফাতি হাজেম আল জাজিরাকে বলেছেন, এই তরুণরা সব আশাই হারিয়ে ফেলছে। কোনো চাকরি নেই, ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়মিত হামলা, অনেক সহকর্মী, বন্ধু ও প্রতিবেশী হারিয়েছে তারা।
ফিলিস্তিন ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের মহাসচিব মুস্তাফা বারঘোতি বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ড বিপজ্জনক উসকানি। আমার মনে হয়, এই সংঘাত বড় ধরনের ইন্তিফাদায় রূপ নিতে পারে।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ২০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গত তিন সপ্তাহে ইসরায়েলে ৪টি হামলায় ১৪ জন নিহত হন। এসব হামলার পর পশ্চিম তীরে অভিযান জোরদার করে ইসরায়েল। এসব হামলার মধ্যেই মধ্য তেল আবিবে একটি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে।
প্রতিদিন গড়ে অন্তত দু’জন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা৷ জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷
সারা বিশ্বে শিশুরা যেখানে গড়ে ৬ দশমিক ৮ থেকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার) ভুগছে, সেখানে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে এ হার ৩৪ দশমিক ১ থেকে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ইসরায়েলি সেনাদের আগ্রাসনের ঘটনা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে। ঘর যেখানে তাদের নিশ্চয়তা আর আনন্দের উৎস হওয়ার কথা, তার বদলে ভীতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। এর ফলাফল হচ্ছে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে, তারা চুপচাপ, বিষণ্ন কিংবা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতি সপ্তাহে ইসরায়েল একজনের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে। এর আগের এক দুঃখজনক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৪ বছর গড়ে প্রতি তিন দিনে একটি ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ