ছাত্রলীগ এখন কেবল ছাত্রসমাজের কাছে এখন আতঙ্কের নাম নয়, গোটা দেশের নিকট আতঙ্কের নাম। ছাত্র রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি মাস্তানির মহাউৎসবে মেতে উঠেছে এই সংগঠনটি। থেমে নেই করোনা মহামারির এই দুর্যোগ মুহূর্তেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অমর একুশে হলের সামনে অবস্থিত আনন্দ বাজারের দোকান মালিকদের থেকে এককালীন ১০ লাখ ও প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে ঢাবির অমর একুশে হল ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা এনায়েত এইচ. মনন ও ইমদাদুল হাসান সোহাগের বিরুদ্ধে।
চাঁদা না দেওয়ায় বাজারের সাতটি দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। ১০ দিন ধরে দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে। চাঁদা না দিলে হত্যার হুমকিও দেন বলে জানান এসব দোকান মালিকদের একজন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেনাবেচায় দিন-রাত ব্যস্ত থাকা দোকানগুলোর মালিকরা এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছেন। তাদের দোকানের কর্মচারীরাও এখন বেকার সময় কাটাচ্ছেন। কেউ ভয়ে দোকান খুলছেন না।
এর আগে গত ২ মার্চ ‘উপঢৌকন’ চেয়ে পলাশী বাজারে হানা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
গত মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। অমর একুশে হল শাখার সভাপতি হয়েছেন এনায়েত এইচ মনন, সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইমদাদুল হাসান ওরফে সোহাগ। এনায়েত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন আর ইমদাদুল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অনুসারী।
আনন্দ বাজারের ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, গত ১২ মার্চ রাত আটটার দিকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে আনন্দ বাজারে যান অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা এনায়েত এইচ মনন ও ইমদাদুল হাসান। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের (ব্যবসায়ী) সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও চাঁদার জন্য হুমকি-ধমকি দেন। একপর্যায়ে সাতটি দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন তারা। এরপর ১৮ মার্চ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে একটি হোটেলে ডেকে নিয়ে এককালীন ১০ লাখ ও প্রতি মাসে এক লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করেন এনায়েত ও ইমদাদুল। চাঁদা না পেলে তারা ব্যবসায়ীদের প্রাণনাশের হুমকি দেন। চাঁদা দিতে না পারায় দোকানগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে।
তবে অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা এনায়েত এইচ মনন ও ইমদাদুল হাসান চাঁদা চাওয়া ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এনায়েত বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। ষড়যন্ত্র করে এ অভিযোগ আনা হচ্ছে।’ ইমদাদুলের ভাষ্য, ‘এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। বিষয়টি আমার জানা নেই।’
চাঁদা না দেওয়ায় বাজারের সাতটি দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। ১০ দিন ধরে দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে। চাঁদা না দিলে হত্যার হুমকিও দেন বলে জানান এসব দোকান মালিকদের একজন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের পরিচয় ব্যবহার করে কেউ যদি কোনো ধরনের অনৈতিক এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র বিরোধী কোনো কাজ করে, তাহলে আমরা অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।
অমর একুশে হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. ইসতিয়াক এম সৈয়দ বলেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো অফিসিয়াল অভিযোগ আমি পাইনি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর প্রফেসর ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে শুনেছি কিন্তু ডিটেইলস জানি না। কারো ব্যবসা বন্ধ করতে চাইলে কেউ সেক্ষেত্রে তাদের প্রতি যথাযথ পদক্ষেপ অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নেয়ার পরামর্শ থাকলো। দোকান বন্ধ করে ঘরে বসে থাকা তো কোনো সমাধান না। এছাড়াও আমাদের কাছে লিখিত কোনো অভিযোগও করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রুপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সর্বগ্রাসী নতুন রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যাকে পারো তাকে ধরো, আওয়ামী লীগ করো নীতিতে চলতে গিয়ে ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতা কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৭
আপনার মতামত জানানঃ