টিসিবির পণ্য কিনতে প্রায় প্রতিদিন ভোর থেকেই ভিড় করেছেন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়া মানুষ। কম টাকায় কাঙ্ক্ষিত পণ্য হাতে পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন তারা। আবার সড়ক দিয়ে টিসিবি’র ট্রাক যেতে দেখলেই সেই ট্রাকের পেছন পেছন মানুষজনকে ছুটতে দেখা গেছে।
নিত্যপণ্যগুলো ক্রমশ আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শুধু ভোগ্যপণ্য নয়। দাম বাড়ছে সবকিছুতেই। তেলের দামের অজুহাত তুলে পটল থেকে রড, সিমেন্ট সবকিছুর দামই বেড়েছে।
তেলের দাম বাড়ার পেছনের অজুহাত ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ। তার প্রভাবে জ্বালানি তেলের দামসহ আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম কতটুকু বেড়েছে এবং দেশে কতটুকু বাড়ানো হলো, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। সাধারণত সেই কাজটি কখনোই করা হয় না এবারও হচ্ছে না।
সরকারের ব্যর্থতা
দেখা উচিত আন্তর্জাতিক বাজারে কোন কোন পণ্যের দাম বেড়েছে, বাংলাদেশে বাড়ানো হলো কোন কোন পণ্যের দাম। তেল- গ্যাসের প্রভাবে ভোগ্যপণ্য নয়, এমন পণ্যের দাম বাড়া কতটা যৌক্তিক।
রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখলে, বলা হয়, জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে অনেকটা। কিন্তু এখানে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সম্পদ ‘কতিপয়’-এর দখলে থাকায় বৈষম্য এবং আয়ের তারতম্য রয়েছে।
করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। তছনছ করেছে দেশের অর্থনীতিকেও। গোড়া থেকেই বলা হচ্ছিল, করোনার কারণে বিশ্বে উৎপাদন কম হবে। উৎপাদন কম হলে বাজারে পণ্য ঘাটতি দেখা দেয়া স্বাভাবিক এবং বাজারের সূত্রমতে তার দামও বাড়বে। মুশকিল হলো করোনার সময় কাজ হারিয়ে এবং আয় কমে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
স্থানীয় বাজারে শুধু নয়, বিশ্ববাজারেও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এখন এই যে বাজারের বর্তমান চিত্র, তার পূর্বাভাস আগেই পাওয়া যাচ্ছিল বাজারে একটা হুলুস্থুল পরিস্থিতি তৈরি হবে। সেটা তো আগের নানা দুর্যোগ থেকেই জানা।
তাই পণ্য আমদানি, পণ্য সরবরাহ বা বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগাম ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল। ভোগ্যপণ্যের বাজার যখন উচাটন, তখন অন্যান্য সেবা মূল্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবুর করা যেত কি না সেটিও বিবেচ্য।
টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটে চলা মানুষগুলোর সামনে কিন্তু উন্নয়নের ঝলক আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই গত দেড় দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। এখনো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অনেকটাই নির্মাণ পর্বে আছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে সেবার মান বাড়বে। জীবন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে।
কতিপয়ের সম্পত্তির সঙ্গে জনগোষ্ঠীকে ভাগ করে দেওয়ায় মাথাপিছু এই আয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু গড় মানুষের আয় কিন্তু তলানিতে। বাড়ছে নতুন গরিবের সংখ্যা। মধ্যবিত্তের অবনমন ঘটছে।
এই বাস্তবতায় গড় মানুষ যখন তার পরিবারের জন্য এক লিটারের তেলের বোতল কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে, তখন তার নজরে উন্নয়নের তিল কখনোই উপভোগ্য হবে না। সুতরাং অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যক্তির উদরের সুখও নিশ্চিত করা জরুরি। কল্যাণ রাষ্ট্র নিশ্চয়ই এই বিষয়ে দরদি হবে।
মধ্যবিত্তদের অবস্থা ও সরকারের অর্জন
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি খোলা ট্রাকে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে।
সাধারণত বস্তিবাসী, রিকশাচালক, নিম্নবিত্তের মানুষই টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন দিতেন। করোনা আসার পর টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধীরে ধীরে লম্বা হতে থাকে। নিম্নবিত্তের সাথে অল্প-স্বল্প মধ্যবিত্তও টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে যান। দ্রব্যমূল্যের প্রবল চাপে মধ্যবিত্তের লজ্জার দেওয়াল ভেঙে যাচ্ছে।
এখন তারাও নিম্নবিত্তের মানুষের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনছেন। টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়ালেই পণ্য পাওয়া যাবে, তেমন গ্যারান্টি নেই। তাই টিসিবির ট্রাক দেখলেই হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে যাওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
আগে লাইন ধরতে পারলে টিসিবির পণ্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই টিসিবির ট্রাক দেখলেই হুড়োহুড়ি, লাইন ধরা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি নিত্যদিনের ঘটনা। সব মধ্যবিত্তের লজ্জার দেওয়াল এখনও ভেঙে যায়নি। তাই অনেকে বাসা থেকে অনেক দূরে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান বা ক্যামেরা দেখলে মুখ লুকিয়ে ফেলেন। যাতে আত্মীয়-স্বজনরা দেখে না ফেলেন।
তবে আত্মীয়-স্বজনরা না দেখলেও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দেখে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদেরও এখন টিসিবির লাইনে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রীর এই উপলব্ধির মধ্যে একধরনের গর্ব আছে। ভালো ভালো পোশাক পরা মধ্যবিত্তদেরও টিসিবির লাইনে টেনে আনতে পেরেছেন, এটা অবশ্যই সরকারের বড় অর্জন।
মাথাপিছু আয়ের শুভঙ্করের ফাঁকি
বস্তুত আয় বাড়ছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি জীবনযাপনের ব্যয়ও বেড়েছে। ধরা যাক, কারও মাসিক আয় এক হাজার টাকা বাড়লো, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় যদি বাড়ে এক হাজার একশ’ টাকা, তাহলে ওই এক হাজার টাকা আয় বৃদ্ধির কোনও মানে হয় না।
মাথাপিছু আয় বরাবরই একটা বিতর্কের ইস্যু। কারণ, এটি গড় হিসাব। ধনী গরিব সবার আয় এবং জাতীয় উৎপাদন যোগ করে যে গড় করা হয় সেটিই মাথাপিছু আয়। তাতে কারও মাসিক আয় হয়তো এক কোটি টাকা, সেখানে হয়তো অবৈধ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকাও আছে। পক্ষান্তের একজন দিনমজুরের মাসিক আয় যদি হয় ১৫ হাজার টাকা, তাহলে ওই এক কোটির সঙ্গে এই ১৫ হাজার যোগ করে যদি দুজনের গড় আয় বের করা হয়, সেটা অর্থনীতির ভাষায়ও হাস্যকর।
কিন্তু তারপরও মাথাপিছু আয়ের একটা গুরুত্ব আছে। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্ট্যান্ডার্ড বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা হচ্ছে আয় বৈষম্য। এখানে অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একটি গোষ্ঠী, যে টাকার বিরাট অংশই জনগণের ট্যাক্সের পয়সা। অর্থাৎ যে টাকা লুটপাট হয় সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং কেনাকাটায়। এই লুটপাটের টাকা আবার চলে যায় বিদেশে।
কিছু টাকা খরচ হয় দেশের ভেতরেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনা এবং রাজকীয় রিসোর্ট তৈরিতে। কিন্তু এর বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গে যুক্ত নয় বা সেই সুযোগও যাদের নেই, তারাই আবার করোনা মহামারি শুরু হলে কাজ হারায়, বেকার হয়, বেতন কমে যায়। সংসারের খরচ সামলাতে না পেরে পরিবার পরিজনকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকায় একা থাকেন কিংবা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে নিজেও চলে যান।
করোনার পিক সময়ে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষ ট্রাকে করে আসবাবপত্র নিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে গেছেন। সুতরাং টিসিবির লাইন তো দীর্ঘ হবেই। অন্যদিকে অর্থনীতির নানা সূচকে দেশ যেহেতু এগিয়ে যাচ্ছে, ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে।
একদিকে করোনা মহামারির ধাক্কা, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, এ দুই সংকটে বিপর্যস্ত যে বিরাট জনগোষ্ঠী, মূলত তাদের কারণেই টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। একদিকে আয় বন্ধ কিংবা হ্রাস, অন্যদিকে সব জিনিসের দাম বৃদ্ধির এই শাঁখের করাতে চেরাই হতে হতে মধ্যবিত্তও চলে আসছেন নিম্নবিত্তের জন্য নির্ধারিত টিসিবির লাইনে।
চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যের দামই বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচও অনেকাংশে বেড়েছে। এরইমধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। তার মানে টিসিবির লাইনে ভালো পোশাক পরা লোকের লাইন আরও দীর্ঘ হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ