টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ফ্যামিলি কার্ড প্রাপ্তি এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য ক্রয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের সক্ষমতা যাচাইপূর্বক যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি না নিয়ে দ্রুত এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ, উপকারভোগীর তালিকাভুক্তি ও পণ্য ক্রয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই ইতিবাচক উদ্যোগের পরিপূর্ণ সুফল পায়নি।
প্রকৃত উপকারভোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফ্যামিলি কার্ড তালিকা থেকে বাদ পড়ার বিপরীতে উপকারভোগীদের চাহিদা, পণ্য ক্রয়ের সামর্থ্য এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনা না করায় এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে।
এ বছরের রমজান মাসে নিম্ন আয়ের ১ কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পণ্য সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে সময় সরকারের আড়াই হাজার টাকা নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত ৩৫ লাখ পরিবারকে এই কর্মসূচির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, আড়াই হাজারনগদ সহায়তাপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পায়নি। আর যারা পায়নি, তাদের মধ্যে ৮০ দশমিক ৪ শতাংশই অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাদ পড়ার কথা জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) এক ওয়েবিনারে ‘টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম।
ওয়েবিনারে জানানো হয়, ঢাকা ও বরিশাল বাদে দেশের ৩৫টি জেলার ১ হাজার ৪৭ জন নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ বছরের ১৮ থেকে ২৬ এপ্রিল এই গবেষণার জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এক সভায় করোনার সময় নগদ প্রণোদনা পাওয়া ৩৫ লাখ দরিদ্র কর্মহীন পরিবারকে টিসিবির ভর্তুকি মূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রমজানে ৩৫ লাখ পরিবারের সঙ্গে আরও ৬৫ লাখ পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করে মোট ১ কোটি পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তবে এ গবেষণার জরিপে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতা যারা ইতিপূর্বে আড়াই হাজার টাকা নগদ সহায়তা পেয়েছিলেন, তাদের ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পাননি। যারা কার্ড পাননি তাদের ৮০ দশমিক ৪ শতাংশকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
জরিপে উত্তরদাতাদের ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করেন, তালিকা প্রণয়নের সময় যোগ্য-হতদরিদ্র ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সচ্ছল ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তাদের আত্মীয়স্বজনকে এবং ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, তালিকায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
অন্যদিকে ফ্যামিলি কার্ড পাওয়া ব্যক্তিদের ৪ শতাংশ জানান, কার্ড পেতে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে কার্ড পেতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। ৪ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা উপকারভোগী বাছাই কমিটির সদস্য নন এমন ব্যক্তির কাছ থেকে কার্ড পেয়েছেন। এই কার্ডদাতারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের নেতা।
উপকারভোগী বাছাই কমিটির সদস্য নন এমন ব্যক্তির কাছ থেকে কার্ড পেয়েছেন। এই কার্ডদাতারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের নেতা।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলগুলোতে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, দ্বীপ ও চরাঞ্চল এবং দুর্যোগপূর্ণ হাওর এলাকায় পণ্য সরবরাহে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় টিসিবি।
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার প্রায় ৩,৩০০টি পরিবারের কাছে টিসিবি’র সাশ্রয়ীমূল্যের এসব পণ্য পৌঁছাতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। আবার, ডিলারদের অবস্থান বা বিক্রয় পয়েন্ট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সংলগ্ন হওয়ায় প্রত্যন্ত এলাকা (বিশেষ করে, চরাঞ্চল, হাওর ও দুর্গম পাহাড়ী এলাকার জনগণ) থেকে এসে পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী ছিলেন না অনেক কার্ডধারী।
জরিপে অংশগ্রহণকারী কার্ডপ্রাপ্ত উপকারভোগীদের সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে যাতায়াত বাবদ গড়ে ৩৩ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। অন্যদিকে নির্ধারিত কোনো কোনো বিক্রয় কেন্দ্রে একজন মাত্র বিক্রয়কর্মী থাকায় জরিপে অংশগ্রহণকারী উপকারভোগীদের গড়ে ১.২ ঘন্টা ও সর্বোচ্চ ১০ ঘন্টা পর্যন্ত লাইনে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপকারভোগী দৈনিক আয় থেকে বঞ্চিত হয় এবং দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বয়স্ক উপকারভোগীদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯.২৫ শতাংশ উপকারভোগী নারী ও প্রতিবন্ধীতাসহ ব্যক্তিদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ করেছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তথ্য প্রকাশ ও প্রচারে ঘাটতি থাকার কারণে লক্ষিত উপকারভোগীদের উল্লেখযোগ্য অংশ এই কার্যক্রমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং দুর্নীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
তাছাড়া কার্যকর অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা না থাকায় দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। জরিপে তালিকাভুক্তি, কার্ড বিতরণ ও পণ্য ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হওয়া উপকারভোগীদের ৮৯.৯ শতাংশ অভিযোগ করেননি বা করতে পারেনি। এর মধ্যে ৩৪.৩ শতাংশই হয়রানির ভয়ে অভিযোগ করেনি।
টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করা টিআইবির দশ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- জনপ্রতিনিধি কর্তৃক উপকারভোগীদের প্রাথমিক তালিকা তৈরির পর ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা চূড়ান্ত করা; নারী, প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি, দলিত, আদিবাসী, প্রভৃতি প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা।
শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা এবং বিতরণের সময়, তারিখ ও স্থান ইত্যাদি তথ্য সকল পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা; বিনামূল্যে তালিকাভুক্তি ও কার্ড বিতরণে অর্থ লেনদেন না করার বিষয়ে উপকারভোগীদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম (যেমন: এসএমএস প্রদান, ফ্যামিলি কার্ডে এ ধরনের তথ্য মুদ্রণ করে দেওয়া ইত্যাদি) পরিচালনা করা; উপকারভোগীদের চাহিদা ও সামর্থ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে প্যাকেজে পণ্যের ধরন, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণ করা ইত্যাদি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৯
আপনার মতামত জানানঃ