শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ছে মশার উপদ্রব। কর্তৃপক্ষের মশক নিধন কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও রাজধানীতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব অতি মাত্রায় বেড়েছে। দিন-রাত মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। জনমনে এডিস মশার আতঙ্ক কাজ করছে, এ জন্য যে কোনো মশার বৃদ্ধিতেই মানুষের আতঙ্ক বেড়ে যায়।
ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে পর্যাপ্ত মশার ওষুধ মজুদ রয়েছে বলে দাবি করছে সংস্থা দুটি। আর এদিকে মশার কামড়ে ঢাকাবাসী যন্ত্রণায় রয়েছেন। যতই দিন যাচ্ছে, এই যন্ত্রণার মাত্রা ততই বাড়ছে।
উত্তরা, রামপুরা, মধ্যবাড্ডা, মিরপুর, গাবতলী, শ্যামলী, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়াসহ রাজধানীর সব এলাকায় মশার উপদ্রব বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরে শীতের মৌসুম শেষ হওয়ার পর গরমের আভাস আসায় মশার রাজত্ব শুরুর ইঙ্গিত মিলছে।
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সব এলাকার চিত্রই এরকম। সড়ক থেকে ঘর, স্টেশন থেকে গণপরিবহন সর্বত্রই মশার উপদ্রব। মশার গুনগুন শব্দের সঙ্গে হুল ফোটানো নিত্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মার্চ মাসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মশার ঘনত্ব আরও চার গুণ বাড়বে। ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বছরের এ সময়ে মশার জীবনচক্রের গতিশীলতা বেড়ে যায়। এ সময়ে মশা ডিম বেশি পাড়ে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে মশার ঘনত্ব প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
রাজধানীর মশা নিধনের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন বলছে, মশা নিধনে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। তবে সাঁড়াশি কোনো অভিযান নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা সারওয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, কীটনাশকের যা মজুত আছে তা দিয়ে সাত-আট মাস ভালোভাবে চলে যাবে। এটা শেষ হওয়ার আগেই আবার মজুত করা হবে।
হঠাৎ মশার উপদ্রব বাড়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পানি কমে গেছে। তাই পানির ঘনত্ব বেড়ে নোংরা হয়েছে বেশি। কিউলেক্স মশা নোংরা পানিতে জন্মে। তাই এই সময় থেকে কিউলেক্স মশা বাড়ে।
মশার উপদ্রব শুরু হয়ে গেলেও এই কর্মকর্তা মনে করেন, গতবারের তুলনায় মশা এবার সহনশীল পর্যায়ে এবং অনেক কম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মার্চ মাসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মশার ঘনত্ব আরও চার গুণ বাড়বে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, আমার জানা মতে এই মৌসুমে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখনও আছে। তার পরেও যেসব এলাকা সমস্যাসংশ্লিষ্ট, সেখানকার কর্মকর্তা ও সুপারভাইজারকে বলছি জরুরি ব্যবস্থা নিতে।
সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। দুই সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। নগরবাসীর পক্ষ থেকে ঢাকার দুই মেয়রের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা মশার উপদ্রব কমাতে জরুরিভাবে উদ্যোগ নিন।
গত ৩ মার্চ ডেঙ্গু ও মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সভাপতিত্ব করেন। সভায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম নাগরিকদের সচেতনতার কথা বলেন। মশামুক্ত নগর গড়তে বদ্ধপরিকর বলেও জানান তিনি।
সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা নিধনে চলতি বছরের জন্য পর্যাপ্ত কিটনাশক মজুত রয়েছে।
মশক নিধন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, কিউলেক্স মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। এখানে কারও বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) কিউলেক্স মশার মোট ৯২৫টি হটস্পট শনাক্ত করা হয়। এসবের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সাতারকুল। এরপর রয়েছে মিরপুর। ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে মশা নির্মূলে নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা ৫৫০। পাশাপাশি আরও কিছু অনিয়মিত কর্মীসহ সর্বমোট মশককর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় ১ হাজার জন।
অন্যদিকে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যে গত বছর বেশকিছু নতুন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের দাবি, তারা ৭৫টি ওয়ার্ডেই নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে প্রতি ওয়ার্ডে ১৪ জন করে ৭৫টি ওয়ার্ডে মোট ১ হাজার ৫০ জন কর্মী লার্ভিসাইডিং, এডাল্টিসাইডিং এবং সমন্বয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। মশক নিধনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কাজ চলমান রেখেছি। তবে এই সময়ে এসে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। তাই আমরাও আমাদের কার্যক্রম আরও গতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জানা গেছে, সর্বশেষ অর্থবছরে মশক নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় আট কোটি টাকা কমিয়ে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। যেখানে তার আগের অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সর্বশেষ অর্থ বছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৫৮ কোটি টাকা।
মশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকেই দায়ী করছেন কীটতত্ববিদরা। তারা বলছেন, বছরজুড়ে যেখানে মশা নিধন পরিচালনা করার কথা সেখানে ডেঙ্গু কমতে থাকার পর দুই সিটি করপোরেশনে কোনও কাজই হয়নি। মশার ওষুধ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন খোদ কাউন্সিলররাই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মশক নিধনে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে যে রকম তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্য এলাকায়, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের নতুন অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। মশার ওষুধ ছিটানোর ব্যাপারে সব এলাকায় সমান দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু মশা নানা রোগের ভাইরাস ছড়ায়, সেহেতু মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই সেসব রোগ থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে এটাই প্রত্যাশা।
তারা বলেন, শুরু থেকেই ওয়ার্ডগুলোতে জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ক্র্যাশ প্রোগাম চালানোর দরকার ছিল। বছরজুড়ে দুই সংস্থার এই কাজে অবহেলা ছিল। মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রতি সাত দিন অন্তর ড্রেন, ডোবা ও নোংরা এলাকা পরিষ্কার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে দেখেছি, বছরের অন্য যে কোনও সময়ের তুলনায় এখন মশার ঘনত্ব তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। মশার প্রজননস্থলগুলো পরিষ্কার করে এ উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মার্চের পর থেকে আরও বাড়তে থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১১
আপনার মতামত জানানঃ